কুরবানীর মাহাত্ম্য
—-মাওলানা ইলিয়াস আইয়ূবী ও এম এইচ রহমান
পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির ঊষা লগ্ন থেকেই কুরবানী প্রথা চালু রয়েছে। আদি মানব হযরত আদম (আঃ) এঁর যুগ শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)সহ সকল নবী-
রাসুলগণ এ শর-ই বিধান মেনে চলেছেন। হযরত আদম (আঃ) এর সময়ে কুরবানীর বিধান ছিল ভিন্ন, সে সময়ে কুরবানীর গ্রহনযোগ্যতা সরাসরি আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী হতো। আসমান হতে অগ্নি এসে কুরবানীর নিমিত্তে প্রদেয় বস্তুকে ভস্মীভূত হওয়ার মাধ্যমে কুরবানীর ফয়সালা হয়ে যেত। কালক্রমে কুরবানীর পদ্ধতি এবং ধারণা পাল্টেছে, সর্বশেষ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সময়ে কুরবানীর পূর্ণতা লাভ করেছে।
হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন
(তাফসীরে নাসায়ী, কাশশাফ) ।
কুরবানীর মূল লক্ষ্য হলো ত্যাগ স্বীকার ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে মহান স্রষ্ঠার নৈকট্য লাভ করা। ইলমে ফিক্হের ভাষায় নির্দিষ্ট দিনে পশু(কুরবানীর) যবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাকে কুরবানী বা উযহিয়্যা বলা হয়।
ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য ৯ই জিলহজ্জ্ব থেকে ১৩ই জিলহজ্জ্ব দিনগুলোতে যাদের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকবে তাদের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন দোয়া করলেন- হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে এক সৎকর্ম পরায়ণ সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাকে এক অতি ধৈর্য্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার কাজে সহযোগীতা করার বয়সে (১২-১৩ বছরে) পৌঁছাল, তখন ইব্রাহিম (আঃ) স্বপ্নের মাধ্যমে তাঁর প্রিয় বস্তুকে কুরবানী করার নির্দেশ পান। অতঃপর তিনি তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান উট সমুহ কুরবানী করেন। কিন্তু তৃতীয় রাতেও ইব্রাহিম (আঃ) আবারও স্বপযোগে তাঁকে কুরবানী করার নির্দেশ পান। এমতাবস্থায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) উপলদ্ধি করলেন পৃথিবীর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু হলো তাঁরই ঔরসজাত পুত্র স্নেহের ধনহযরত ইসমাইল(আঃ)। তখন ইব্রাহিম (আঃ) বললেন বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, এখন বল-তোমার অভিমত কী? সে বলল, “হে পিতা আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অর্ন্তভূক্ত পাবেন” — সুরা আস সাফফাত আয়াত; ১০০-১০২।
আল্লাহর নির্দেশ পালন এবং মহান স্রষ্ঠার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হয়রত ইব্রাহিম (আঃ) তার সর্বাধিক প্রিয় পুত্র ইসমাইল(আঃ) -কে কুরবানীর করার জন্য মিনা প্রান্তরে তাঁর গলায় ছুরি চালান। কিন্তু পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে হযরত ইসমাইল(আঃ) এর স্থলে জান্নাত থেকে জিব্রাইল (আঃ) এর আনীত একটি দুম্বা কুরবানী হয়। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন- ”নিশ্চয় ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু। আমি তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি। ইব্রাহিমের উপর শান্তি বর্ষিত হউক। এভাবেই আমি সৎকর্ম পরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। — সুরা আস সাফফাত; আয়াত ১০৬-১১০।
সুরা কাউসার এ কুরবানী সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক বলেন- “(হে নবী) আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানী করুন” আয়াত -২ এবং সুরা আন আম; ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন- “(হে নবী) আপনি বলুন আমার নামাজ, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।”
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “ সাহাবায়ে কিরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুল্লাহ (সঃ) কুরবানী কী? উত্তরে নবী করিম (সঃ) বললেল- ”এ হলো তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সুন্নাত”। সাহাবায়ে কিরাম পুনরায় আরজ করলেন, এতে আমাদের কী কল্যাণ নিহিত আছে? নবী করিম (সঃ) বললেন- ”কুরবানীর পশুর প্রতিটা পশমের জন্য রয়েছে এক একটি করে নেকি (ইবনে মাজাহ)”।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের নাম হলো কুরবানী। কুরবানীর পশুর গোশত এবং রক্ত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না শুধু অন্তরের তাকওয়াই আল্লাহর কাছে পৌঁছে। কুরবানীর উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন এবং তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা, সুরত ও ধন- ঐশ্বর্য্য দেখে বিচার করেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখে বিচার করেন -(মুসলিম)।
সুতরাং কুরবানী সম্পর্কে সঠিক ও মূল বিষয় বুঝতে হলে কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি যাচাই বাছাই করা প্রয়োজন। কুরআন ও হাদিসের আলোকে আল্লাহর দেওয়া বিধানগুলো সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অন্বেষন করতে পারলেই কুরবানীর উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে। মানুষের মনের পশুত্বকে কুরবানী করে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তাঁর সৃষ্টি জগতের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করা গেলেই কুরবানীর মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে।
শুধুমাত্র কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ দেখে কুরবানীর মাহাত্ম্য বোঝা যাবে না।