সামাজিক বন্ধন এবং নারীর মর্যাদা
—আফরোজা পারভীন সীমা
জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় নারী এবং পুরুষ পরষ্পরের হাতে হাত রেখে একে অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত , নারী-পুরুষের সম্মিলিত এ ধারা অব্যাহত রয়েছে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। যদিও আমাদের সমাজে ধারণা করা হয় পুরুষ সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, নারীর থেকে বেশি সক্ষম এবং উন্নত পৃথিবী গড়তে তাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। কিন্তু মানব সৃষ্টির আদি ইতিহাস তালাশ করলে দেখা যায় আদিমানবী (নারী) বিহনে আদিমানব (পুরুষ) জড়বৎ এবং নিস্প্রভ, যা স্বর্গদ্যানেই প্রমাণিত। নারী পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক এবং মহান স্রষ্টা সেভাবেই তাদের তৈরী করেছেন। পুরুষ বিহনে নারীর জীবনে আস্তার ঘাটতি পূরণ করা যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি নারীর ভালোবাসা ও সহমর্মীতা ছাড়া পুরুষের কর্মনিষ্ঠ জীবনের গতি এবং কর্মদক্ষতাকে তরাণ্বিত করা অসম্ভব। নারীর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগীতা ছাড়া পুরুষের একার পক্ষে সৃষ্টিশীল কিছুই করা সম্ভব নয়। সুতরাং পুরুষ যে সকল কিছুর একক দাবীদার সেটা ভাবা একবারে অবান্তর।
একজন গৃহিনী সংসারের জন্য সারাদিন অক্লান্ত পরিশম্র করার পরও তার সামাজিক মর্যাদা অতি নগণ্য। একজন গৃহিনী ও কর্মজীবী নারীকে সারাদিন ঘরে-বাইরে কাজ করার পরও রান্না-খাওয়া, সন্তান পালন সবই তাকেই করতে হয়। অফিস বা কর্মব্যস্ততার কারনে বাসায় ফিরতে দেরী হলে, এমনকি অতি জরুরী প্রয়োজনেও যদি বাইরে যেতে হয় তখন তাকে হাজারো প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। অথচ একজন পুরুষ তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যদি ঘরের বাইরে গিয়ে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করে বা বিনা কারনে রাত করে বাসায় ফেরে তবে তাকে কোনো প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে নারী সংসারের চালিকা, পরিবার তাকে ছাড়া একবারেই অচল। তারপরও শুধুমাত্র লিঙ্গ বৈষম্যের কারনে একজন নারীর সম্মান ও মর্যাদা পুরুষের থেকে কম বলে দেখা হয়। তাঁর প্রাপ্য নূন্যতম সম্মানটুকু দেখানো হয় না, সমাজ তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কৃপণতা করে। যদিও মায়ের(নারী) অবস্থান সবার উপরে এবং সম্মানের ক্ষেত্রে নারীর মর্যদা রক্ষার বিষয়ে সবাই একমত। পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে দামী হলেন একজন মা যিঁনি একজন নারী। মার্তৃরূপী এ নারীগোষ্ঠী ছাড়া পৃথিবীতে জীবের কোনো অস্থিত্বই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু ঘরে-বাইরে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মানের ঘাটতি সর্বত্রই চোখে পড়ে।
আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং একটা বড় ভূমিকা পালন করছে যা মানুষের জীবন যাত্রাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে স্যােসাল নেটওয়ার্কিং ব্যবহারে পুরুষ ̄স্বাধীন তার কোনো বিধিনিষেধ নেই অথচ নারীর বেলাতে ভিন্ন মত, তার গন্ডিটাকে সংকোচিত করার মনোভাবে ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দেওয়া হয়। মজার বিষয় হলো ছেলেমেয়ের স্কুলে আনা নেওয়া, চাকরী বা অর্থ উপার্জন হয় এমন কিছুতে নারীর সরাসরি অংশগ্রহনে পুরুষ শাসিত এ সমাজ তেমন আপত্তি তোলে না অর্থাৎ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তখন আর প্রশ্নের প্রয়োজন
পড়ে না।
সংসারের প্রতি অঘাত ভালোবাসার কারনে নারী অতি অল্পতেই তুষ্ট থাকে, নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে সংসারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা লক্ষণীয়। পরিবারপরিজন এবং সংসারের জন্য নারী দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও বেশিরভাগ স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি নূন্যতম সম্মান দেখানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। আপনজন এবং ভালোবাসার জায়গা থেকে নারীর প্রতি একটুখানি সম্মান দেখালে, তার যোগ্য মর্যাদা দিলে কী এমন ক্ষতি?
বিশেষ করে স্বামীর পক্ষ থেকে এ সম্মান পেলে নারী গর্ব অনুভব করে। এছাড়া পরিবার বা সমাজ একজন নারীকে তার প্রাপ্য সামাজিক মর্যাদা, একটু সম্মান দেখালেই নারী নিজেকে ধন্য মনে করে। একটু ভালোবাসা একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই সে তুষ্ট হয়, খুশি থাকে। যা একজন নারীকে ব্যক্তি জীবনে স্বস্তি দিতে পারে।
নারী পুরুষের পরস্পরের প্রতি ভালোলাগা এবং ভালোবাসার আকর্ষণ সৃষ্টিগত। ভালোলাগার এ তেয়াস মেটানোর জন্য ধর্মীয় বিধান অমান্য করে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে এবং যথেচ্ছা যৌনাচারের পথ প্রশস্ত করে। এমনি প্রেক্ষাপটে সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ হিসাবে এককভাবে নারীকেই চিহ্নিত করা হয়।
অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো মনগড়া ধর্মীয় অনুশাসন চালু করে সামাজিকতার আবরণে নারীকে পরনির্ভরশীল করে গন্ডিবদ্ধ জীবন ব্যবস্থায় বাধ্য করা হয়। নারী ̄স্বভাবতই কোমল মনের অধিকারী এবং উচ্চাকাঙ্খার জন্য সহজেই প্ররোচনার ফাঁদে পা দেয়। এছাড়া তার শারিরীক কাঠামো ও আবেদনময়ী অঙ্গ ভঙ্গির জন্য প্রতিনিয়তই হেনেস্তা হবার ভয় থাকে। বিশেষ করে অফিসে বা কর্ম ̄স্থলে উর্ধ্বতন পুরুষ কর্মকর্তার কাছে অধঃস্থন নারীদের হেনস্তা বা সম্ভ্রম হারানো ঝুঁকি প্রতি মুহূর্তে রয়েই যায়। নারী নিজেকে দূর্বল ভাবলে অন্যরা তার সুযোগ নেবে, এ ক্ষেত্রে নারীর উচিৎ হবে অপরাধীর নিপিড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। কারো অনৈতিক আবদার মুখবুজে সহ্য করলে তার ফল হবে মারাত্মক। এক্ষেত্রে তাকে জিম্মিদশায় পতিত হতে হয় এবং বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। তবে পরিস্থিতি আজ অনেক পাল্টেছে। নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটায় মেধাশক্তির জোরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নির্ভরশীল জীবন থেকে তারা আজ অনেকটাই বের হয়ে এসছে। কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগীতায় নারী নিজের যোগ্যতাবলে সম্মুখযুদ্ধে অকুতোভয় সেনানী হিসাবে এগিয়ে চলেছে।
পুরুষকে যেমন এককভাবে দোষারোপ করে লাভ নেই, তেমনি নারীকেও সতর্ক হতে হবে। কোনো ধরণের প্রলোভনে প্ররোচিত না হয়ে কর্মক্ষেত্র সহ সর্বত্রই নিজের সম্মান যেন বজায় থাকে সে খেয়াল রাখাটা খুর জরুরী। নারী যেন ভোগ্য পণ্য হিসাবে নিজেকে অন্যের কাছে উপস্থাপন না করে বা সস্তা পণ্য হিসাবে কারো লালসার শিকারে পরিণত না করে সেটা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। নিজের সম্মান রক্ষার্থে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী চলাচল সর্বক্ষেত্রেই নারীকে অনেকটা সুরক্ষা দিতে পারে। তা না হলে ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায় হোক নারীর নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদা নিয়ে শঙ্কা রয়েই
যাবে।
মন্দ যা তা সবার বেলাতেই নিন্দনীয়, হোক সে নর অথবা নারী। নিন্দনীয় কাজ থেকে বেরিয়ে এসে পার ̄পারস্পরিক আস্থা এ সংকট কাটানো না গেলে সামাজিক এ অবক্ষয় রয়েই যাবে, যা নারী পুরুষ কারো জন্য কাম্য হতে পারে না। পারষ্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গাটা নিশ্চিত করা খুবই দরকার, তা না হলে সামাজিক অবক্ষয় বিশেষ করে ডিভোর্স বা পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা সারাক্ষণ ঝুঁকির মধ্যে থাকতে বাধ্য। পুরুষের উচিত হবে নারীর প্রতি সহমর্মীতার মনোভাব নিয়ে বৈষম্য ভূলে প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করা যদিও সেটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই দায়িত্ব।
অবস্থান যাই হোক না কেন নারী পুরুষ বলে কথা নেই, প্রাপ্যতা অনুযায়ী সম্মান ও মর্যদা হওয়া চাই সমানে সমান। তাহলেই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজিকভাবে নারী-পুরুষের পারস্পরিক এ বন্ধন অটুট থাকবে। সম্মানের জায়গাটাকে অক্ষুন্ন রেখে পরস্পরের প্রতি সৌহাদ্যপূর্ণ আচরণ, বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা গেলেই নারী এবং পুরুষের মধ্যে আগামীর জন্য সুন্দর জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত হতে বাধ্য।