আব্দুর রহমান বুলবুল, ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে: ব্রাহ্মণবাড়িয়া। দেশের ৬৪ জেলার একটি। সীমান্তবর্তী এই জেলার কদর দেশের সর্বমহলে। এক সময় সুরের জনপদ ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এর খ্যাতি ছিলো দেশের সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে। কালের স্রোতে আজ সবই যেন বিলীন হচ্ছে! তাই বলে কি এখানকার শত-হাজার বছরের ঐতিহ্যও হারিয়ে যাবে? অথচ বাস্তবে এমনটিই হতে যাচ্ছে! জেলার প্রায় দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে। পড়ে আছে নানা অবহেলা-অনাদরে।
সেই ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের কথা। তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উন্নীত হয় জেলায়। টিপরা কিংবা ত্রিপুরা’র পরে মেঘনা-তিতাস বিধৌত এতদাঞ্চল ছিলো কুমিল্লা জেলা। তারও আগে, অর্থাৎ ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের আগে ছিলো সরাইল ‘পরগণা’র অাওতায়। তৎসময় এই জনপদ ছিলো মোমেনশাহী তথা আজকের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভূক্ত। প্রাচীন বাংলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম ‘সমতট’ বলেও ইতিহাস পাঠে জানা গেছে।
তখন ব্রিটিশ আমল। সেই ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরা জেলা হয়। সেই সময়ে মোমেনশাহী তথা ময়মনসিংহ জেলা থেকে আলাদা হয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা। ময়মনসিংহের কিয়দাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা ত্রিপুরা জেলার অংশে পরিণত হয়। সেই ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল,দাইদপুর, হরিপুর, বেজুরা ও সতরকণ্ডল পরগনা, ময়মনসিংহ জেলা থেকে আলাদা হয়ে ত্রিপুরা জেলার অংশে অন্তর্ভূক্ত হয়। আর এভাবেই কেটে যায় আরো ত্রিশটি বছর।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বড় অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নাসিরনগর মহকুমা। আর এই অবস্থা খুব বেশি সময় দীর্ঘায়িত হয়নি। নাসিরনগর মহকুমা হিসেবে স্থায়িত্ব ছিলো মাত্র ১৫ বছর। তবে নাসিরনগর মহকুমা হবার আট বছরের মাথায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয় আরেক ধাপ অগ্রগতি। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া উন্নীত হয় পৌরসভায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা-নাসিরনগর মহকুমা হিসেবে অতিবাহিত হয় আরো সাতটি বছর। অবশেষে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা হয়। এমনিভাবেই অতিবাহিত হতে থাকে ব্রিটিশ তথা পরাধীন ভারত আমল।
নানান ঘটনাবহুলতায় মহকুমা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তখন গোটা ভারতবর্ষজুড়েই চলে ব্রিটিশবিরোধী বহুমাত্রিক আন্দোলনের ঘনঘটা। এসবেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে আজন্ম সংগ্রামী ব্রাহ্মণবাড়িয়া। অবশেষে লেজ গুটাতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ বেনিয়ারা। সেই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন ভারত-পাকিস্তানের জন্ম। আর এরই মধ্যদিয়ে হয় দেশভাগ। আজকের বাংলাদেশ হয় পূর্ব পাকিস্তান। এর মাত্র ১৩ বছরের মাথায়, ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরা জেলার পূর্ব পাকিস্তান অংশের নামকরণ হয় কুমিল্লা জেলা। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয় মহকুমা শহর।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান হয় ঠিকই। কিন্তু শাসকগোষ্ঠির মাঝে উপনিবেশিক মনোভাব যেন থেকেই যায়! যার প্রেক্ষিতেই মাতৃভাষা আন্দোলনসহ অধিকার আদায়ের নানাবিধ আন্দোলন সংগ্রামে কেটে যায় একটি দশক। অবশেষে ১৯৭১ সালে, গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এতেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভূমিকা স্বর্ণোজ্জ্বল। স্বাধীনতা লাভের পর দানা বাঁধে জেলা আন্দোলন। ঝরে রক্ত। কেটে যায় চৌদ্দটি বছর। অবশেষে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যে অত্যন্ত সুপ্রাচীন। এই শহরকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অসংখ্য ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে ছবির এই ভবনটি। জেলাবাসী অনেকের কাছে ‘লালঘর’ নামেও পরিচিত এই ভবনের মাঝামাঝি উপরাংশে 1881 খচিত। সেই ১৮৮১ সালের ঐতিহ্যের এই ভবনটিই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশাসনিক ভবন ছিলো। আজ ২০১৮, সেই হিসেবে এর বয়স ১৩৭ বছর। প্রায় দেড়শ’ বছর বয়েসী কালের সাক্ষী বয়োবৃদ্ধ এই ভবনটি আজ অনাদরে! দাবী শুধু একটাই, এটি সংস্কারের।