কবির হোসেন, কাপ্তাই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বললে এবং লিখলে শেষ হওয়ার মত নয়।আমার পিতা মৃতঃ আলী আহম্মদ চৌধুরী রাঙ্গামটি কাপ্তাইয়ের কেপিএম পেপার মিলস্ কর্মস্থল ছিলেন। বড় ভাইয়ের সংস্পর্শে স্কুলের ছাত্র অবস্থা হতে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। এবং ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র লীগ ও আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতাম।
চট্রগ্রামের রাউজান কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধু জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম। এবং জীবনে এই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং বক্তব্য শুনেছি। এছাড়া ৪ জানুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে আ’লীগের নবনির্বাচিত এমপিদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করি।এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি। পরে ৭ মার্চ রেসকোর্স জনসভায় যোগদান জন্য আমারা ৪ বন্ধু বাদশা,রমজান আলী ও সিরাজ বাঙালী মিলে ট্রেনে করে ঢাকায় চলে যাই।২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার পর আমরা চন্দ্রঘোনা মিটিং মিছিলে সক্রিয় হই।
এপ্রিল মাসে প্রথম সপ্তাহে আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে চলে যাই।এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আমি ডাক্তার রেজাউল করিম, রুমেল ও বেলাল ভাই ( পরবর্তীতে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল) সহ ফেনীর ছোত্তাখোলা থেকে ভারতের হরিনা ক্যাম্পে যাই। সেখানে বীর প্রতীক ইসহাক ভাই ও রাঙ্গামাটির বন বিক্রম ত্রিপুরা এস এম ইউসুফ, ছাবের আহম্মদ আসগরিসহ প্রমুখ নেতার সঙ্গে দেখা হয়। হরিনা ক্যাম্পে কয়েকদিন অবস্থানের পর আমরা নৌ কমান্ডো ট্রেনিংয়ের জন্য মনোনীত হই । পরবর্তী আগরতলায় ৯১ বি এস এফ হেডকোয়ার্টারে কয়েকদিন অবস্থানের পর ধর্মনগর রেল স্টেশন হয়ে কলকাতার হাওড়া স্টেশন হয়ে ঐতিহাসিক পলাশী প্রান্তরে ভাগীরথীর পাড়ে নৌকমান্ড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।এক মাস যাবৎ। আমাদের কয়েকজনকে উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য বিহারে চাকুলিয়া পুরাতন বিমান বন্দরে ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছাই। ওই ট্রেনিং ক্যাম্পে ফেনীর প্রখ্যাত ছাত্রনেতা জোয়নাল হাজারীসহ অনেক নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা হয়। মাস ব্যাপী ট্রেনিং শেষে কলকাতার কল্যানী মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ট্রানজিট ক্যাম্পে কয়েকদিন অবস্থান করা হয়। স্টেশন হয়ে আবার আগরতলা চলে আসি। সেখান থেকে আমাদেরকে মেলাঘর কোম্পানি নিয়ে যাওয়া হয়। এবং আমার নামে অস্ত্রবারুদ ও একটা রাশিয়ান স্টেনগান বরাদ্দ পাই টিম লিডার হিসাবে।পরবর্তী আমাদেরকে ফেনীর পশুরামের রাজা নগর ক্যাম্পে মেজর জাফর ইমাম সাহেবের ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য হিসেবে ক্যাম্পে অবস্থান করি। বেলুনিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এবং সে যুদ্বে সহযোদ্ধা রুমেল শত্রুর গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়।আমি, বারেক, মেজর জাফর ইমাম এর জীপেকরে আহত রুমেলকে বেলুনিয়া হাসপাতালে ভর্তি করি।পরে ৪৪ ডোগরা রেজিমেন্টের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে রুমেলকে অপারেশন করা হয়। অপারেশনে আমি ও নোয়াখালীর বারিক ভাই আহত রুমেলকে রক্ত দেই।২দিন পর আমরা বেলুনিয়া ক্যাম্পে ফেরত আসি। সেখান থেকে আমাদেরকে নোয়াখালীর সোনাই মুড়ির গজারিয়া ডাঃ আনিছ সাহেবের কাছারি ঘরে ক্যাম্প স্থাপন করি। রেল লাইনের পূর্ব দিকে প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা রুহুল আমিনের বাহিনী হাবিলদার নূর মোহাম্মদের বাহিনী এবং আমি ও আমার দল যৌথ আলোচনার মাধ্যমে রেল লাইনের পশ্চিম পাশে অবস্থান করি। এবং রেল লাইনের পূর্ব পাশে রুহুল আমিন সাহেবের বাহিনী অবস্থান করে নির্ধারিত সময় ভোর চারটায় যুদ্ধ আরম্ভ করি। গোয়েন্দা সংস্থার খবর ছিল সোনাই মুড়ি রেল স্টেশনে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার মিলে ২ শতাধিক ছিল। যুদ্ধ যখন শুরু হয় ভোরবেলা জানতে পারি মাঝরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা কুমিল্লা নাথের পটুয়া হয়ে ঢাকা চলে গেছে। সকাল ১০টায় যুদ্ধ শেষ হয়।৬০/৬৫ জন রাজাকারকে জীবিত ও আহত অবস্থায় বন্দী করে রশি দিয়ে বেঁধে রাখি। এবং রাজাকার কমান্ডার দুহাত তুলে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হঠাৎ করে রাজাকারের হাতে থাকা চাইনিজ গুলি দিয়ে পরপর দুটি করে গুলি করে এতে শহীদ হাবিলদার নূর মোহাম্মদ ও শহীদ হামিদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শহীদ হয়।এসময় রশি বাধা রাজাকারদের ক্ষিপ্ত হয়ে জনগণ গুলি করে হত্যা করা হয়। ডিসেম্বরের ১০-১২ তারিখ বিভিন্ন মারফত খবর পেতে থাকি যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর। আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নোয়াখালী চৌমুনির দিকে পায়ে হেঁটে যাত্রা করি। আমাদের সাথে আশেপাশের হাজারো জনতা শ্লোগান দিয়ে এক হয়। এবং বেগমগঞ্জ হাই স্কুল মাঠের কাছাকাছি পৌঁছাই। তখন চিৎকার শুনতে পাই যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তখন আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের নিকট থাকা অস্ত্র আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করতে থাকি। তখন আর আমরা কেউ কারো নির্দেশনা মানছি না। বেমগঞ্জ সোনাইমুড়ি থেকে নিজ বাবার কর্মস্থল রাঙ্গামাটি কাপ্তাই কর্ণফুলী পেপার মিল কেপিএম চলে আসি।
বর্তমান আ’লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাতিভাতাসহ দুই ঈদে বোনাস,বিজয় দিবস ভাতা ও বৈশাখী ভাতা পাই।আমার ২ ছেলে এক মেয়ে মুক্তিযুদ্ধের কোটা সরকারি চাকরি পেয়েছে। আমি ও আমার মুক্তিযোদ্ধারা আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আমরা বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। এবং উনার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করি।