চেচেন নেতা রামজান কাদিরভের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে খবর, তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাতে রাজি নন। সম্প্রতি আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাদিরভের শারীরিক অবস্থা দ্রুত অবনতি হচ্ছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই পুতিনের ‘অনুগত সৈনিক’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, পুতিন চান না কাদিরভের উত্তরসূরি হিসেবে আসুক তাঁর তৃতীয় ছেলে, যিনি গত নভেম্বরে সতেরো বছরে পা দিয়েছেন।
মে মাসের শুরুতে কাদিরভ একটি রুশপন্থী সংবাদমাধ্যমে জানান, তিনি পদত্যাগ করতে চান। তিনি বলেন, “অন্য একজন [চেচেন নেতা]-র নিজস্ব ভাবনা, নিজস্ব পরিকল্পনা থাকবে। আমি আশা করি, আমার এই অনুরোধকে সমর্থন করা হবে।
এর পরেই ৭ মে পুতিনের সঙ্গে তাঁর একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে কাদিরভ জানান, ইউক্রেন যুদ্ধে ৫৫ হাজার চেচেন সেনা লড়ছে এবং চেচনিয়ায় তাঁর শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের খতিয়ান পেশ করেন।
তবে পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কেউই মুখ খোলেননি। পরের দিন কাদিরভ বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, “আমি যা-ই বলি না কেন, কঠোরভাবে অনুরোধ করলেও, সিদ্ধান্ত নেন একজনই—আমাদের সুপ্রিম কমান্ডার।” কাদিরভের এমন মন্তব্যে মনে করা হচ্ছে, তিনি এখনো পুতিনের প্রতি অনুগত। চেচনিয়ার বিভিন্ন রাস্তা ও এলাকার নামকরণ করা হয়েছে পুতিনের নামে।
কাদিরভের সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে অবগত, এমন দুজন ব্যক্তি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, কাদিরভের পছন্দের উত্তরসূরি নিয়ে পুতিনের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছে। কাদিরভ তাঁর তৃতীয় ছেলে, ১৭ বছর বয়সী আদম কাদিরভকে উত্তরসূরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুতিন তাতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তিরা আরও জানান, মানবাধিকার সংগঠনগুলো চেচনিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর কঠোর দমন-পীড়নের বিষয়টি নথিভুক্ত করেছে।
২০২৩ সালে রামজান কাদিরভ একটি ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায় তাঁর ছেলে আদম, এক ব্যক্তিকে মারধর করছেন। ওই ব্যক্তি কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।
রামজান তাঁর ছেলের ‘জন্য গর্বিত’ বলে জানান। তবে সরকারি তদন্তকারীরা জানান, বয়সের কারণে আদমের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ আনা যাবে না। আদমের ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি সরকারি পদে নিয়োগ হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো চেচনিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান।
সূত্র মারফত জানা যায়, আদমকে ‘প্রিন্স’ হিসেবে বড় করা হয়েছে এবং বাস্তব জগৎ সম্পর্কে তাঁর সীমিত অভিজ্ঞতা রয়েছে। চেচনিয়ার সংবিধানে বলা হয়েছে, ৩০ বছরের কম বয়সী কেউ এই অঞ্চলের প্রধান হতে পারবে না।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে যখন তাঁর বাবা, আখমাত কাদিরভকে হত্যা করা হয়, তখন রামজানের বয়স ছিল ২৮ বছর।
কাদিরভের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগের আরও একটি কারণ হলো তাঁর শারীরিক অবস্থা। জানা যায়, তিনি নেক্রোটাইজিং প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং কিডনি সমস্যায় ভুগছেন, যার কারণে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়।
বিভিন্ন সূত্রে খবর, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি প্রতিদিন গ্রোজনির ‘এআইমেড ফ্যামিলি ক্লিনিকে’ যান এবং সেখানে অনেক সময় রাত কাটান।
এছাড়াও, কাদিরভ তাঁর ব্যস্ত সময়সূচি দেখানোর জন্য আগে থেকে রেকর্ড করা ভিডিও ব্যবহার করেন, যা কয়েক দিন ধরে প্রচার করা হয়। যদিও আল জাজিরা এই দাবিগুলো যাচাই করতে পারেনি। তবে কাদিরভের অসুস্থতা নিয়ে অন্যান্য গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো, কাদিরভ দীর্ঘদিন ধরে যেসব নিয়ম-কানুন মেনে আসছিলেন, অসুস্থতার কারণে তিনি নাকি তা ভাঙতে বাধ্য হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, গত মার্চ মাসে পবিত্র রমজান মাস শেষ হওয়ার পরে তিনি চেচেনবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কোনো টেলিভিশন ভাষণ দেননি। এমনকি, ১৯৪৪ সালে স্তালিনের আমলে চেচেনদের নির্বাসনের ঘটনার বার্ষিকীতেও তিনি যোগ দেননি।
এদিকে, ‘নিসো’ নামক একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলের বরাত দিয়ে জানা যায়, কাদিরভ তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘খুব চিন্তিত’। তবে ক্রেমলিন তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বলে জানা যায়।
বর্তমানে, চেচনিয়ার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা, ৫১ বছর বয়সী আপ্তি আলাউদ্দিনভকে ক্রেমলিনের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও তাঁর নেতৃত্বাধীন সেনারা ইউক্রেনে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।
কাদিরভ দীর্ঘদিন ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রিয়েল এস্টেট ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর পরিবারের জন্য একটি আর্থিক আশ্রয় তৈরি করেছেন। দুবাইয়ের এক রুশ-ভাষী রিয়েল এস্টেট এজেন্ট জানিয়েছেন, “চেচেনরা আমাদের সেরা ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম। তারা নগদ টাকার বস্তা নিয়ে আসে।
বর্তমানে চেচনিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক সময় মনে করা হতো, রাশিয়ার অংশ হিসেবে চেচনিয়ার অবস্থান মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি রোধ করতে পারে। কিন্তু দুটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং উত্তর ককেশীয় অঞ্চলে ‘চরমপন্থীদের’ বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে চলা সহিংসতার কারণে চেচনিয়া বর্তমানে রাশিয়ার সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত প্রদেশে পরিণত হয়েছে।
মস্কো থেকে এখানে প্রচুর অর্থ আসে, যা কাদিরভ বিভিন্নভাবে সরিয়ে দেন। তিনি বিশাল প্রাসাদ তৈরি করেছেন, বিলাসবহুল স্পোর্টস কার সংগ্রহ করেছেন এবং তাঁর জন্মদিনে বক্সার মাইক টাইসনসহ পশ্চিমা সেলিব্রিটিদের পারফর্ম করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো কাদিরভ ও তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, অপহরণ এবং কথিত ‘চরমপন্থীদের’ সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ এনেছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কাদিরভের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি নিয়োগ হলেও খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। তবে ‘নিসো’ টেলিগ্রাম চ্যানেলের আনসার ডিশনির মতে, নতুন শাসক হয়তো কাদিরভের ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ‘সংস্কারক’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইবেন।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা