মাসিক নিয়ে আজও লুকোচুরি: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি আলোচনা।
ঋতুস্রাব বা মাসিক নারীদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রতি মাসে এই শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান নারীরা। কিন্তু আজও অনেক সমাজে, এমনকি আধুনিক যুগেও, এই বিষয়টিকে ঘিরে লজ্জা ও লুকোচুরির সংস্কৃতি বিদ্যমান।
মাসিকের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ভিন্নতা সংস্কৃতিভেদে এক এক রকম। কোথাও একে জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে দেখা হয়, আবার কোথাও এটি ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের নারীদের মধ্যেও মাসিকের ধারণা নিয়ে রয়েছে বিভিন্নতা। কারো কাছে এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, আবার কারো কাছে এটি এখনো লজ্জার বিষয়। অনেক পরিবারে মাসিকের সময় মেয়েদের আলাদা করে রাখার প্রবণতা দেখা যায়।
সমাজে প্রচলিত ধারণা, অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারের কারণে অনেক নারী এই সময়ে মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক থেকেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন।
ইসলাম ধর্মে মাসিকের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছে। ইসলামে মাসিকের সময় নারীদের নামাজ ও রোজা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনেও মাসিকের সময় নারীদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং তাদের প্রতি কোনো ধরনের বৈষম্য করতে নিষেধ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, আয়েশা (রা.)-এর মাসিক চলাকালীন সময়ে তাঁর প্রতি রাসূল (সা.)-এর ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ আমাদের জন্য অনুকরণীয়। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, ইসলামে মাসিককে লজ্জার বিষয় হিসেবে নয়, বরং নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়।
পরিবারে মেয়েদের মাসিকের বিষয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উচিত মেয়েদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে খোলামেলাভাবে জানানো। তাদের শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া দরকার।
মাসিকের সময় মেয়েদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং তাদের মানসিক সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন। পরিবারের এই সহযোগিতা মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং সমাজের নেতিবাচক ধারণা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।
মাসিক স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। স্যানিটারি ন্যাপকিন বা অন্যান্য স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে এই ধরনের উপকরণ সরবরাহ করা যেতে পারে।
এছাড়া, বিদ্যালয়ে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে মাসিকের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। মাসিক নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করতে গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা এবং মাসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত লজ্জা ও ভীতি দূর করা সম্ভব।
আসুন, আমরা সবাই মিলে মাসিক বিষয়ক লজ্জা ভেঙে ফেলি। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করি, যেখানে নারীরা তাদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতন হবে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা