মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিটার হেজসেথ-এর ‘সিগন্যাল’ চ্যাট নিয়ে বিতর্ক চলছে। তাঁর দাবি, এই চ্যাটে যুদ্ধের কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য প্রমাণ অন্য কথা বলছে। সম্প্রতি একটি ঘটনার সূত্রে এই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ‘দ্য আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে। পত্রিকাটি জানায়, তারা ঘটনাক্রমে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি ‘সিগন্যাল’ গ্রুপ চ্যাটে যুক্ত হয়েছিল।
এই চ্যাটে ইয়েমেনে মার্কিন বিমান হামলার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছিল। পত্রিকার সম্পাদক জেফরি গোল্ডবার্গ এই বিষয়ে বিস্তারিত জানান।
তিনি জানান, চ্যাটে পাওয়া তথ্যে “যুদ্ধ পরিকল্পনার” উল্লেখ ছিল, যেখানে অস্ত্রশস্ত্র, লক্ষ্যবস্তু এবং সময় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছিল। তবে, সংবেদনশীলতার কারণে গোল্ডবার্গ বিস্তারিত বার্তা প্রকাশ করেননি।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ (National Security Council) এই চ্যাট থ্রেডের সত্যতা নিশ্চিত করেছে এবং কীভাবে গোল্ডবার্গের নম্বর যুক্ত হলো, তা খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে।
তবে, হোয়াইট হাউস এবং পিটার হেজসেথ ‘যুদ্ধ পরিকল্পনা’ নিয়ে আলোচনার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এর পরেই ‘দ্য আটলান্টিক’ পুরো টেক্সট থ্রেড প্রকাশ করে।
প্রকাশিত বার্তাগুলোতে দেখা যায়, হেজসেথ বিমানের উড্ডয়ন, বোমা নিক্ষেপের সময় এবং লক্ষ্যবস্তুর সম্ভাব্য গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য পাঠাচ্ছিলেন।
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিটের একটি টুইট পোস্টের দিকে ইঙ্গিত করা হয়, যেখানে তিনি জানান, “কোনো ‘যুদ্ধ পরিকল্পনা’ নিয়ে আলোচনা হয়নি।”
উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র হুতি বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালায়। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই গোষ্ঠীটি লোহিত সাগরে জাহাজে বারবার হামলা চালিয়েছে।
তবে, ‘দ্য আটলান্টিক’-এর দ্বিতীয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ এক টুইটে লেখেন, “কোনো স্থান, কোনো সূত্র ও পদ্ধতি, কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না।” হেজসেথও একই ধরনের মন্তব্য করেন, যেখানে তিনি জানান, প্রকাশিত বার্তাগুলোতে কোনো নাম বা লক্ষ্যবস্তু উল্লেখ করা হয়নি।
পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও-ও একই সুরে কথা বলেন।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত সামরিক পরিভাষায় ‘যুদ্ধ পরিকল্পনা’ বলতে ব্যাপক ও বিস্তারিত একটি দলিল বোঝায়, যেখানে সৈন্য সমাবেশসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ থাকে।
এই ধরনের পরিকল্পনা শত শত বা হাজার পৃষ্ঠারও হতে পারে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সিগন্যাল’-এর বার্তাগুলোতে থাকা তথ্যগুলো সামরিক ভাষায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হিসেবেই গণ্য করা হবে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একজন ফেলো, মাইকেল ও’হানলন বলেন, “লক্ষ্যবস্তুর কোঅর্ডিনেট দেওয়া ছাড়া, এটি ছিল প্রায় বিস্তারিত একটি পরিকল্পনা।”
গোল্ডবার্গ তাঁর প্রথম প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, হেজসেথের বার্তাগুলোতে ইয়েমেনে আসন্ন হামলার বিস্তারিত তথ্য ছিল, যার মধ্যে লক্ষ্যবস্তু, ব্যবহৃত অস্ত্র এবং আক্রমণের সময়সূচি সম্পর্কে জানানো হয়েছিল।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জেন পিসাকির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গোল্ডবার্গ বলেন, বার্তাগুলোতে আক্রমণের সুনির্দিষ্ট সময়, লক্ষ্যবস্তু, এমনকি আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ছিল।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেক্সট মেসেজগুলো হয়তো পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ছিল না, তবে এতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল। জনস হপকিন্স স্কুল অফ অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এর অধ্যাপক এবং ‘ওয়ার অন দ্য রক্স’ ওয়েবসাইটের সম্পাদক নরা বেনসাহেল বলেন, “এগুলো সামরিক শক্তি ব্যবহারের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল।
আমি বুঝি না, কীভাবে প্রশাসন বলতে পারে এগুলো যুদ্ধ পরিকল্পনা নয়, কারণ এগুলো যুদ্ধের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা।”
অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টাই সেইডুল বলেন, টেক্সট মেসেজগুলো একটি ‘অপারেশন প্ল্যান’ (Operation Plan – OPLAN)-এর মতো ছিল না, তবে এটি ছিল ‘ক্লিফ নোটস’-এর মতো, যেখানে সামরিক অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য ছিল।
তাঁর মতে, এটি ছিল “নিরাপত্তার গুরুতর লঙ্ঘন।”
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং প্রাক্তন সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হেইডি এ উরবেন বলেন, নতুন প্রকাশিত টেক্সটগুলো অপারেশনাল বিস্তারিত তথ্যের সমান।
নেভিতে ২৫ বছর কাজ করা এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেওয়া থান ক্লের মতে, প্রতিরক্ষা বিভাগ যেহেতু ‘যুদ্ধ পরিকল্পনা’ শব্দটি ব্যবহার করে না, তাই হেজসেথরা কৌশলগতভাবে এই সুযোগটি নিচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, “ইয়েমেন চ্যাটটি শতভাগ সংবেদনশীল তথ্য, যা আসন্ন অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো প্রকাশ করে।”
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘সিগন্যাল’ ব্যবহারের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবার্ট এল ডিইজ বলেন, “গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা বিভাগের সবাই জানে, ‘সিগন্যাল’ যথেষ্ট সুরক্ষা দেয়।
তবে, কোনো গুরুতর গোয়েন্দা সংস্থা এই অ্যাপ ব্যবহার করে না।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা