মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ এবং সিআইএ প্রধান জন র্যাটক্লিফের সিগন্যাল চ্যাট-এ পাঠানো কিছু বার্তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন বর্তমান ও প্রাক্তন মার্কিন কর্মকর্তারা। তাঁদের আশঙ্কা, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা বিষয়ক এই বার্তাগুলো ইরানের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করতে পারে।
সিএনএন-এর সূত্রে জানা যায়, মার্চ মাসে হুতি বিদ্রোহীদের ওপর চালানো একটি হামলার পরিকল্পনা নিয়ে সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। সেই সময়ে প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথের পাঠানো বার্তায় আক্রমণের সময়, ব্যবহৃত অস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছিল।
তবে কর্মকর্তাদের মতে, ওয়াল্টজ ও র্যাটক্লিফের বার্তাগুলোতেও স্পর্শকাতর তথ্য ছিল। আটলান্টিক সম্পাদক জেফরি গোল্ডবার্গকে অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি হওয়া এই চ্যাটে তাঁদের বার্তাগুলো পাঠানো হয়।
র্যাটক্লিফের একটি বার্তায় উল্লেখ করা হয়, হুতি বিদ্রোহীদের ওপর গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য সিআইএ তাদের কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। তবে, অভিযান বিলম্বিত হলে হুতি নেতৃত্ব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ভালো সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। কর্মকর্তাদের মতে, এই বার্তাটি একদিকে যেমন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হুতি বিদ্রোহীদের ওপর নজরদারির বিষয়টি প্রকাশ করে দেয়, তেমনি তাদের কার্যক্রমের পদ্ধতি সম্পর্কেও ইঙ্গিত দেয়।
ওয়াল্টজের একটি বার্তায় হুতি বিদ্রোহীদের ওপর চালানো হামলার বিস্তারিত বিবরণ ছিল। তিনি জানান, সামরিক বাহিনী একজন শীর্ষস্থানীয় হুতি নেতাকে তাঁর বান্ধবীর অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করতে দেখেছে এবং তাঁর পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছে। কর্মকর্তাদের মতে, এর ফলে হুতি বিদ্রোহীরা জানতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর নজরদারি করছে এবং ভবিষ্যতে তারা সেই নজরদারি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিতে পারে।
একজন প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “হুতিদের গতিবিধি সব সময় কঠিন ছিল। এখন আপনি তাদের বুঝিয়ে দিলেন যে, তারা আমাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছে।”
যদিও ওয়াল্টজ ও র্যাটক্লিফসহ ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, বার্তাগুলোতে কোনো গোপন তথ্য আদান-প্রদান হয়নি। এমনকি সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির শুনানিতে র্যাটক্লিফও তাঁর বার্তার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
তবে বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তাদের অনেকে তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে, হেগসেথ, র্যাটক্লিফ এবং ওয়াল্টজের বার্তায় ব্যবহৃত তথ্যে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল, যা সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। কারণ, এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে।
সিগন্যাল অ্যাপ ব্যবহার করা নিয়ে র্যাটক্লিফের এই পদক্ষেপটি সিআইএর অভ্যন্তরে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। একজন মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, “আমার মনে হয়, এই অ্যাপ ব্যবহারের জন্য তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখা হবে।”
আরেকজন প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, র্যাটক্লিফ এমনভাবে কথা বলেছেন যেন তিনি একটি সুরক্ষিত কক্ষে (SCIF) বসে কথা বলছেন, যেখানে গোপন তথ্য নিয়ে আলোচনা করার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথম প্রাক্তন কর্মকর্তা র্যাটক্লিফের এই কাজকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সিআইএর একজন মুখপাত্র সিএনএনকে জানান, “পরিচালক র্যাটক্লিফ যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা রক্ষার দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেন। তিনি চ্যাটে যা বলেছেন, তাতে কোনো সূত্র বা পদ্ধতির ঝুঁকির সম্ভাবনা ছিল না। একমাত্র ক্ষতি হয়েছে হুতি সন্ত্রাসীদের, যাদের নির্মূল করা হয়েছে।”
এই ঘটনার পর, সিআইএর কর্মজীবনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে সিগন্যাল ব্যবহারের বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। সিআইএর নিয়ম অনুযায়ী, কর্মকর্তাদের কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে সিগন্যাল ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। এমনকি, বাইডেন প্রশাসনের অধীনে গত বছর একটি নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ডেস্কটপ কম্পিউটারেও এই অ্যাপ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সরকারের মধ্যে এই অ্যাপটি ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন (end-to-end encryption) প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সবাই দিনরাত সিগন্যাল ব্যবহার করে।”
তবে, সিগন্যালের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এটি একটি ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম (open source), ফলে এর কোড যে কেউ পরীক্ষা করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হ্যাকাররা ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সিগন্যাল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা করেছিল। সিআইএ-তে কর্মপরিচালনাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সিগন্যালে আলোচনা করার অনুমতি নেই। অন্যান্য জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও সতর্ক করেছে যে, এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় এবং ক্লাসিফায়েড নেটওয়ার্কের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, “এটি সবচেয়ে নিরাপদ (বাণিজ্যিক মেসেজিং অ্যাপ), তবে ক্লাসিফায়েড তথ্যের জন্য অনুমোদিত নয়। সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।”
যদিও বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তাদের অনেকে এবং কংগ্রেসের কিছু সদস্য এই ঘটনাকে মারাত্মক ভুল হিসেবে অভিহিত করেছেন, তবে এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সিআইএকে এখনো পর্যন্ত কোনো ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে বলা হয়নি। এমনকি, প্রতিরক্ষা বিভাগও তাদের নিরাপত্তা প্রোটোকলে কোনো পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে না।
তথ্য সূত্র: সিএনএন