যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গাড়ির দাম বাড়তে পারে, কারণ দেশটির সরকার আমদানি করা গাড়ির উপর নতুন শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকান ক্রেতাদের গাড়ি কিনতে বেশি খরচ হতে পারে।
যদিও ট্রাম্প মনে করেন, এই শুল্কের কারণে আমেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারকদের ব্যবসা বাড়বে এবং তারা লাভবান হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের ফলে কানাডা ও মেক্সিকোসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা গাড়ির উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে। শুধু তাই নয়, গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক আরোপ করা হবে।
ফেডারেল সরকারের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কারখানায় বছরে ১ কোটি ২ লক্ষ গাড়ি তৈরি হয়, যার একটি বড় অংশ তৈরি করতে বাইরের দেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যন্ত্রাংশের উপর শুল্কের কারণে শুধু উৎপাদন খরচই প্রতি গাড়িতে ৩,০০০ থেকে ১২,০০০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর বাইরেও, সরবরাহ এবং চাহিদার নিয়ম অনুসারেও গাড়ির দাম বাড়বে।
ট্রাম্পের ধারণা, শুল্কের কারণে গাড়ি প্রস্তুতকারকরা আমেরিকায় উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত হবে, ফলে গাড়ির দাম কমবে। তবে বাস্তবে এটি হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
এরই মধ্যে, বাজারের সাধারণ অর্থনীতি প্রায় সকল ধরণের গাড়ির দামের উপর প্রভাব ফেলবে। নতুন এবং ব্যবহৃত – উভয় ধরণের গাড়ির দামই বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কক্স অটোমোটিভের হিসাব অনুযায়ী, শুল্কের কারণে উত্তর আমেরিকায় গাড়ি উৎপাদন ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এর মানে হল, বছরে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ লক্ষ গাড়ি কম তৈরি হবে। এই গাড়িগুলোর বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের ডিলারশিপগুলোতে বিক্রি হওয়ার কথা।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর যে ৩৭ লক্ষ গাড়ি এশিয়া ও ইউরোপ থেকে আমদানি করে, তার একটি বড় অংশ হয়তো বাজারে পাওয়া যাবে না। এসএন্ডপি গ্লোবাল মোবিলিটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন গাড়ির বাজারের এক-চতুর্থাংশ আসে এই আমদানি করা গাড়িগুলো থেকে।
সরবরাহ কমে গেলে যে দাম বাড়ে, অর্থনীতির এই সাধারণ নিয়ম এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। গ্লোবালডাটার গবেষণা বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেফ শ্যুস্টার বলেন, “সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিলে দাম বাড়বে।”
এডমুন্ডস ডট কম-এর পরিচালক (ইনসাইটস) ইভান ড্রিউরি’র মতে, “দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরবরাহ ও চাহিদার বিষয়টি মৌলিক বিষয়।”
শুল্কের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়লে এবং সরবরাহ কমে গেলে, এমনকি যন্ত্রাংশের উপর তাৎক্ষণিক শুল্ক আরোপ করা না হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি গাড়ির দাম বাড়তে পারে। এছাড়াও, আমদানি করা গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে, বাজারে বিদ্যমান গাড়ির দাম বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন হালকা ট্রাকের উপর শুল্ক আরোপ করে, তখন শুল্কমুক্ত আমেরিকান হালকা ট্রাকের দাম দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল।
গাড়ি প্রস্তুতকারকরা সরাসরি গাড়ির দাম নির্ধারণ করেন না। ডিলারশিপগুলো প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে পাইকারি দামে গাড়ি কিনে সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। তাই, আমদানি খরচ বাড়লে এবং ডিলারশিপগুলোতে গাড়ির সরবরাহ কম থাকলে, দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
২০২১ সালে, যখন গাড়ি প্রস্তুতকারকরা কোভিড পরিস্থিতির কারণে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিল, তখন যন্ত্রাংশের, বিশেষ করে কম্পিউটার চিপের অভাব দেখা দেয়। এর ফলে গাড়ির উৎপাদন কমে যায় এবং দাম বাড়তে শুরু করে। ওই বছর জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন গাড়ির গড় দাম ১৭ শতাংশ বেড়েছিল। একই সময়ে, ব্যবহৃত গাড়ির দামও ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুল্কের কারণে ব্যবহৃত গাড়ির দামও নতুন গাড়ির চেয়ে দ্রুত বাড়তে পারে।
গাড়ির দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে গাড়ির দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল, যা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব ফেলেছিল।
তবে, সম্প্রতি করা কিছু জরিপে দেখা গেছে, অনেক ভোটার মনে করেন ট্রাম্প দাম কমানোর জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন না এবং তারা শুল্কের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প গাড়ি প্রস্তুতকারকদের সতর্ক করে বলেছিলেন, শুল্কের কারণে গাড়ির দাম বাড়ালে তিনি তাদের প্রতি বিরূপ হবেন। এর প্রতিক্রিয়ায় কোম্পানিগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।
ট্রাম্প অবশ্য পরে এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি বিদেশি গাড়ির দাম বাড়লে খুশি হবেন, কারণ এতে আমেরিকান ক্রেতারা আমেরিকান গাড়ি কিনতে উৎসাহিত হবে।
গাড়ি প্রস্তুতকারকরা এখনো দামের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে, তাদের প্রধান বাণিজ্য সংগঠন অ্যালায়েন্স ফর অটোমোটিভ ইনোভেশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শুল্কের কারণে ভোক্তাদের খরচ বাড়বে।
সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জন বোজেলা বলেন, “অতিরিক্ত শুল্ক আমেরিকান ভোক্তাদের খরচ বাড়াবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ির মোট বিক্রি কমিয়ে দেবে।”
গাড়ি প্রস্তুতকারকরাও ব্যক্তিগতভাবে একই কথা বলছেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন