মায়ামির হাইতিয়ান সম্প্রদায়ের প্রার্থনা ও উদ্বেগে কাটছে দিন, স্বদেশে ও আমেরিকায় সংকট ঘনীভূত।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি শহরে বসবাসকারী হাইতিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষজন বর্তমানে কঠিন সময় পার করছেন। একদিকে হাইতিতে গ্যাং সহিংসতার কারণে সেখানকার পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মানবিক সুরক্ষা বিষয়ক সুযোগ-সুবিধাগুলোও ধীরে ধীরে কমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানকার হাইতিয়ানরা তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর আরও বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
নটর ডেম ডি’হাইতি ক্যাথলিক চার্চ, যা এখানকার হাইতিয়ান সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে লেন্ট উপাসনার সময় বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়। এই সময়ে বহু মানুষ একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করেন এবং নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা ঈশ্বরের কাছে জানান। অনেকে মনে করেন, এই প্রার্থনাই তাঁদের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
হাইতি থেকে আসা কেটেলিন ফেভরিয়ার দুই বছর আগে বাইডেন প্রশাসনের মানবিক সহায়তা প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় সেই প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। ফেভরিয়ার বলেন, “আমরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি। আমরা ভালো কিছু হওয়ার জন্য প্রার্থনা করি।”
আশ্রয়প্রার্থী সান্দিনা জ্যাঁও এই প্রার্থনাসভায় যোগ দেন। তিনি ২০২৩ সালে হাইতি ছেড়ে আসেন। সান্দিনা জানান, হাইতির পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, সেখানে এখন ভালোভাবে বসবাস করা কঠিন। তিনি বলেন, “প্রার্থনা করলে, উপাসনায় অংশ নিলে, জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে সাহায্য পাওয়া যায়।”
হাইতিয়ানদের আশ্রয়স্থল: নটর ডেম ডি’হাইতি।
প্রায় ৫০ বছর আগে লিটল হাইতি অঞ্চলে নটর ডেম ডি’হাইতি চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মায়ামির একটি এলাকা, যেখানে হাইতি থেকে আসা মানুষের সংখ্যা অনেক। বর্তমানে ফ্লোরিডায় প্রায় পাঁচ লাখ হাইতিয়ানের বসবাস, যা হাইতির বাইরের বৃহত্তম হাইতিয়ান জনবসতি।
ফাদার রেগিনাল্ড জ্যাঁ-মারি, যিনি ২০০৪ সাল থেকে এই চার্চের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি বলেন, “নটর ডেম ডি’হাইতি এই সম্প্রদায়ের একত্র হওয়ার জায়গা। আমরা হাইতি থেকে আসা অভিবাসীদের এখানকার জীবনে অভ্যস্ত হতে সাহায্য করি।”
বর্তমানে হাইতিয়ানদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শান্তির। ফাদার জ্যাঁ-মারি আরও জানান, “মানুষজন হতাশ, অসহায় এবং একইসঙ্গে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস ধরে রেখেছেন।”
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে গ্যাংগুলো ব্যাপকহারে হামলা চালাচ্ছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। গত এক মাসেই ৬০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা একটি রেকর্ড।
যুক্তরাষ্ট্রে হাইতিয়ানদের আগমন: উদ্বেগের কারণ।
সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় অনেকে হাইতি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিচ্ছেন। ২০২২ সালের শেষের দিকে মানবিক প্যারোল প্রোগ্রামের আওতায় দুই লাখেরও বেশি হাইতিয়ান এখানে আসেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এই প্রোগ্রামটি বাতিল করতে যাচ্ছে। এছাড়াও, সরকার আগস্ট মাস থেকে প্রায় পাঁচ লাখ হাইতিয়ানের ‘অস্থায়ী সুরক্ষা মর্যাদা’ (টেম্পোরারি প্রোটেক্টেড স্ট্যাটাস) বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে।
নটর ডেম চার্চের অনেক সদস্য মনে করেন, নতুন আগতদের কারণে এখানকার সংস্থানগুলোর উপর চাপ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিকে সমর্থন করছেন।
তবে, সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ সদস্য তাঁদের স্বজাতিদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে হাইতি থেকে আসার সময় নিজেদের সামান্য সম্পদ বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন।
নটর ডেম চার্চের সামাজিক সেবা কেন্দ্র, পিয়েরে টুসেন্ট লিডারশিপ অ্যান্ড লার্নিং সেন্টার বিনামূল্যে ডে কেয়ার, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ এবং ভাষা ও প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। এখানকার স্বেচ্ছাসেবক জ্যাঁ সাফ্রান্ট জানান, গত সপ্তাহে ইমিগ্রেশন বিষয়ক একটি সেশন এত দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল যে তা গভীর রাত পর্যন্ত গড়িয়েছিল, কারণ অনেকেই পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
অকটাভিয়াস এমের মতে, নতুন আসা মানুষের সমস্যা পুরো সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, “আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। আমরা জানি না, কী করব।”
প্রার্থনার মাধ্যমে হাইতিয়ানদের শক্তি যোগানো।
এই অনিশ্চয়তার সময়ে প্রার্থনা ও একত্রিত হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নটর ডেম চার্চে আয়োজিত বিশেষ প্রার্থনা সভায় অনেকে অংশ নেন। এই অনুষ্ঠানে বাইবেলের একটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়, যেখানে মোশির নেতৃত্বে ইসরায়েলিরা মিশরীয়দের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
অনুষ্ঠানের মূল বার্তা ছিল, সৃষ্টিকর্তা যা খুলে দেন, তা কেউ বন্ধ করতে পারে না। স্থানীয় ভাষায়, এই বার্তাটিকে ‘বন্ডিয়ে’ বলা হয়, যার অর্থ ‘ভালো ঈশ্বর’।
অনুষ্ঠানে আগতদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের অভিবাসন বিষয়ক উদ্বেগের কারণে প্রকাশ্যে আসতে ভয় পান। দীর্ঘদিন ধরে নটর ডেমে আসা স্যান্ড্রা মোনেস্টিম জানান, এই চার্চ একটি পরিবারের মতো। এখানকার সদস্যরা সবসময় একে অপরের পাশে থাকে।
চার্চের যুবকরা এই অনুষ্ঠানে বিশেষ নৃত্য পরিবেশন করে। যুবকদের একজন সমন্বয়ক অ্যাসেন্সিয়া সেলমন জানান, এই ধরনের আয়োজন যুবকদের আধ্যাত্মিকভাবে এবং সামাজিকভাবে সহায়তা করে।
হেলেন অগাস্টে নামের এক নারী, যিনি ৪০ বছর ধরে এই চার্চের সদস্য, তাঁর ভাইয়ের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন। তাঁর ভাই হাইতিতে শিক্ষকতা করেন। হেলেন বলেন, “হাইতির মানুষের কোনো জীবন নেই। এখন আর কারো সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই, ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে হয়।”
সংকটকালে বিশ্বাসের শক্তি।
নটর ডেমের সদস্যরা ঈশ্বরের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস, গান ও নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে আসা সুজি আরিস্টিড বলেন, “এখানে এলে শক্তিশালী বিশ্বাস পাওয়া যায়। তখন আপনি আপনার আত্মা, শরীর ও মনকে প্রস্তুত করতে পারেন।”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস