শিরোনাম: বিলুপ্তপ্রায় ‘ভয়ঙ্কর নেকড়ে’ কি ফিরে এল? জেনে নিন নতুন গবেষণার কথা
প্রায় ১২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ‘ভয়ঙ্কর নেকড়ে’ (Dire Wolf) -কে কি আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে? সম্প্রতি এমনটাই দাবি করেছে টেক্সাস-ভিত্তিক বায়োটেক কোম্পানি ‘কলোসাল বায়োসায়েন্সেস’। তাদের দাবি, তারা সফলভাবে এই কাজটি করতে পেরেছে।
সোমবার (৮ এপ্রিল, ২০২৪) কোম্পানিটি ঘোষণা করেছে যে তাদের গবেষণায় তিনটি শাবকের জন্ম হয়েছে। তাদের নাম রাখা হয়েছে রোমুলাস, রেমাস এবং খলিসি। তবে বিতর্ক দানা বেঁধেছে অন্য জায়গায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জন্ম নেওয়া নেকড়ে শাবকগুলোর ডিএনএ ধূসর নেকড়ের (Grey Wolf) ডিএনএর খুব কাছাকাছি। ফলে, কলোসালের এই দাবি কতটা সত্যি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আসলে, ভয়ঙ্কর নেকড়ে ছিল উত্তর আমেরিকার এক সময়ের প্রভাবশালী শিকারি প্রজাতি। এদের নিয়ে ‘গেম অফ থ্রোনস’-এর মতো জনপ্রিয় সিরিজেও গল্প তৈরি হয়েছে। জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভয়ঙ্কর নেকড়ের শরীর ছিল শক্তিশালী, গতির চেয়ে তারা শক্তির ওপর বেশি জোর দিত। তাদের পেশি ছিল সুগঠিত, এবং শরীরের গড়নও ছিল ভারী।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস জানাচ্ছে, এই নেকড়েগুলো বিশাল আকারের শিকার করতে পারতো এবং অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতেও তাদের কোনো সমস্যা হতো না। শক্তিশালী শরীরের জন্য তারা ছিল দুর্দান্ত শিকারি। তারা বাইসন, ঘোড়া এবং সম্ভবত ম্যামথের মতো বিশাল প্রাণী শিকার করত। মানুষের শিকারের কারণে তাদের খাদ্যের অভাব হওয়ায় একসময় এই প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাদের জায়গায় আসে ধূসর নেকড়ে।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, CRISPR প্রযুক্তির মাধ্যমে ধূসর নেকড়ের ডিএনএ-তে পরিবর্তন ঘটিয়ে ভয়ঙ্কর নেকড়ের বৈশিষ্ট্যগুলো আনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তাদের শরীর বড় করা হয়েছে, মাথা ও চোয়ালের গঠন পরিবর্তন করা হয়েছে এবং লোমের ঘনত্বও বাড়ানো হয়েছে। এই পরিবর্তনের জন্য ধূসর নেকড়ের কোষ ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর এই কোষগুলো একটি কুকুরের ডিম্বাণুতে প্রবেশ করানো হয়। ভ্রূণ তৈরি হওয়ার পর সেগুলো সারোগেট কুকুরের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ৬২ দিন পর জন্ম নেয় সেই জিনগত পরিবর্তন করা নেকড়ের শাবকগুলো।
রোমুলাস ও রেমাস নামের দুটি পুরুষ শাবক জন্ম নেয় ১ অক্টোবর, ২০২৩-এ। খলিসি নামের একটি মাদি শাবকের জন্ম হয় ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪-এ। বর্তমানে ছয় মাস বয়সী রোমুলাস ও রেমাসের প্রত্যেকের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৩৬ কিলোগ্রামের কাছাকাছি। পূর্ণ বয়সে তাদের ১৮৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা এবং ৬৮ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, খলিসি-র বয়স এখন তিন মাস এবং সেও দ্রুত বেড়ে উঠছে।
তবে, কলোসাল বায়োসায়েন্সেস ‘ডি-এক্সটিঙ্কশন’ বা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার কথা বললেও, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এগুলো আসলে জিনগতভাবে পরিবর্তিত ধূসর নেকড়ে, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির আসল প্রতিরূপ নয়। স্টকহোম ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর প্যালিওজেনেটিক্সের অধ্যাপক লাভ ডালেনের মতে, “জিনগতভাবে দেখলে, এটি ৯৯.৯ শতাংশ ধূসর নেকড়ে। তবে, ভয়ঙ্কর নেকড়ে তৈরি করতে ঠিক কতগুলো জিন পরিবর্তন করতে হবে, সেই বিষয়ে বিজ্ঞান মহলে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে, এই নেকড়েগুলোর মধ্যে ভয়ঙ্কর নেকড়ের জিন রয়েছে, যা তাদের দেখতে গত ১৩ হাজার বছরে দেখা অন্য কোনো নেকড়ের থেকে আলাদা করে।
‘গেম অফ থ্রোনস’-এর লেখক জর্জ আর আর মার্টিন এই প্রকল্পের একজন বিনিয়োগকারী এবং সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, “অনেকের কাছে ভয়ঙ্কর নেকড়ে একটি কল্পনাবাদী চরিত্র, যা কেবল ফ্যান্টাসি জগতে বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবে, আমেরিকান বাস্তুতন্ত্রে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমি জাদু নিয়ে লিখি, কিন্তু তারা (বিজ্ঞানীরা) এই অসাধারণ প্রাণীগুলোকে ফিরিয়ে এনে এক ধরনের জাদু তৈরি করেছেন।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস-এর মতে, এই প্রকল্পটি জিন প্রকৌশলের সীমা আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে সংরক্ষণে সহায়তা করা যেতে পারে। বিশেষ করে, যে সমস্ত প্রজাতির ডিএনএ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি কাজে দেবে। তারা আরও জানিয়েছে, ভবিষ্যতে তারা উলি ম্যামথের মতো অন্যান্য প্রজাতিকেও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
তবে, কেউ কেউ কলোসালের এই ধরনের চেষ্টা নিয়ে সন্দিহান। তাদের মতে, জরুরি সংরক্ষণের বিষয়গুলোর চেয়ে এটা ভিন্ন খাতে মনোযোগ দেওয়ার মতো। বর্তমানে কোম্পানিটিতে প্রায় ৪৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে এর মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০.২ বিলিয়ন ডলার। কলোসাল এই শাবকগুলোর বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য এবং আচরণ পর্যবেক্ষণ করবে এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলো চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা