ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তাদের প্রযুক্তি বিষয়ক নিয়মকানুন শিথিল করতে রাজি নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষেত্রেও তারা এই অবস্থানে অনড় থাকবে। ডিজিটাল নীতিমালার বিষয়ে ইইউ’র শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এই কথা জানিয়েছেন।
ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিজস্ব কিছু নিয়ম রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য সেই নিয়মগুলো তারা পরিবর্তন করবে না। এমনটাই জানিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং প্রযুক্তি বিষয়ক সার্বভৌমত্বের দায়িত্বে থাকা হেনা ভাইরকুনেন। তিনি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ডিজিটাল বিশ্বের জন্য আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, যা আমরা রক্ষা করতে চাই।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যে, বাণিজ্য চুক্তির স্বার্থে ইইউ তাদের ডিজিটাল বিষয়ক কিছু নিয়মকানুন শিথিল করুক। কিন্তু ভাইরকুনেন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে জানান, ইইউ চায় তাদের ডিজিটাল পরিবেশ যেন ন্যায্য, নিরাপদ এবং গণতান্ত্রিক হয়। তিনি আরও যোগ করেন, এই নিয়মগুলো ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা চীন—সব দেশের কোম্পানির জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো অভিযোগ করেছেন, ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ‘আইনগত অস্ত্র’ ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, মেটা’র প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ইইউ’র বিরুদ্ধে ‘সেন্সরশিপের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার’ অভিযোগ করেছেন। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও অ্যাপল ও ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলোর ওপর জরিমানা এবং তাদের বিরুদ্ধে ট্রাস্ট বিরোধী তদন্তের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।
ভাইরকুনেন জানান, ইইউ’র ডিজিটাল নিয়মগুলো মূলত বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর বেশি প্রযোজ্য হবে, কারণ বাজারের বড় খেলোয়াড় হিসেবে তাদের ঝুঁকিও বেশি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য শুল্কের ওপর ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ ঘোষণা করেছে। এই প্রসঙ্গে ভাইরকুনেন বলেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ভালো বাণিজ্য চুক্তি করতে চান এবং কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ চান না।
ইইউ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাণিজ্য আলোচনা ব্যর্থ হলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে ভাইরকুনেন এক্ষেত্রে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ফ্রান্স ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিবেচনা করতে বলেছে। ভাইরকুনেন জানান, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিকল্প প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বর্তমানে, ইইউ ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট (ডিএমএ) এবং ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট (ডিএসএ)-এর অধীনে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। ডিএমএ-এর মূল উদ্দেশ্য হলো, বাজারে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য রোধ করা। অন্যদিকে, ডিএসএ তৈরি করা হয়েছে অনলাইন ক্ষতিরোধের জন্য। এই দুটি আইনের আওতায় বর্তমানে গুগল, অ্যাপল, মেটা ও এক্সের (সাবেক টুইটার) মতো কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
ভাইরকুনেন আরও জানান, তাঁদের লক্ষ্য হলো, কোম্পানিগুলোর ওপর বড় অঙ্কের জরিমানা করা নয়, বরং তারা যেন ইইউ’র নিয়মকানুন মেনে চলে, সেটি নিশ্চিত করা। তিনি ইউরোপের ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ডিজিটাল নিয়মকানুন সহজ করার ওপর জোর দেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের তুলনায় ইউরোপের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম। বিশেষ করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে আছে।
ভাইরকুনেন বলেন, ‘আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, কারণ আমাদের প্রযুক্তির ৮০ শতাংশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে আসে। তাই আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও জানান, এ সপ্তাহে তাঁরা এআই (AI) বিষয়ক পাঁচটি ‘গিগাফ্যাক্টরি’ তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন। যেখানে সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে এআই মডেলগুলোর পরীক্ষা ও উন্নয়ন করা হবে। তবে, ইইউ’র এআই আইন (AI Act) সংশোধনের বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। লেখকদের কপিরাইট সুরক্ষার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
ভাইরকুনেন বলেন, লেখকদের কপিরাইট সুরক্ষার জন্য একটি ভালো সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। একইসঙ্গে, এআই প্রশিক্ষণের জন্য তাদের কন্টেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়াও, ইউরোপীয় কন্টেন্ট যদি এআই প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত না হয়, তবে সেটিও একটি সমস্যা।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান