নজরকাড়া স্বাদের দুনিয়ায় কিছু খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা কেন? বিজ্ঞানীরা এর কারণ খুঁজে বের করেছেন।
আমরা সবাই খাবার পছন্দ করি, কিন্তু কিছু খাবার আছে যা অনেকের কাছেই চক্ষুশূল। যেমন, কারো হয়তো ধনে পাতা একদম ভালো লাগে না, আবার কেউ অলিভ বা অ্যাঙ্কোভিস শুনলেই নাক সিঁটকান।
খাবারের এই পছন্দ-অপছন্দের কারণ কী? সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এর পেছনে বিবর্তন এবং পরিবেশগত কারণগুলো খুঁজে বের করেছেন।
আদিম মানুষেরা তাদের খাদ্য নির্বাচনের জন্য স্বাদ এবং গন্ধের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। তিক্ত স্বাদের খাবারগুলো সাধারণত বিষাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তাই বিবর্তনের ধারায় মানুষ তিক্ত স্বাদযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে শিখেছে।
অন্যদিকে, মিষ্টি স্বাদের খাবারগুলো শরীরে শক্তি যোগায়, তাই মিষ্টি খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে।
কিন্তু বর্তমানে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ফলে খাবারের স্বাদ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এখন আমাদের কাছে নানা স্বাদের খাবার সহজলভ্য, যা আমাদের খাদ্য নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আধুনিক যুগে খাবারের প্রতি অনীহার পেছনে আমাদের শরীর, মস্তিষ্ক, পরিবেশ, বাবা-মা এবং সংস্কৃতিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আমাদের স্বাদ গ্রহণের প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা মিষ্টি স্বাদের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং তিক্ত স্বাদের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই বিতৃষ্ণা বোধ করি।
শৈশবে আমরা মা-বাবার কাছ থেকে খাবারের বিষয়ে অনেক কিছু শিখি। মায়ের খাদ্যাভ্যাস, পরিবারের অন্যান্য সদস্যের খাবার গ্রহণের ধরন—এগুলো আমাদের পছন্দের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
এমনকি গর্ভবতী অবস্থায় মায়ের খাদ্যতালিকাও শিশুর রুচি গঠনে ভূমিকা রাখে।
খাবার খাওয়ার পরিবেশও আমাদের স্বাদের ধারণা তৈরি করে। গান শুনতে শুনতে খাবার খেলে আমাদের স্বাদ গ্রহণের অভিজ্ঞতা প্রভাবিত হয়।
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী কিয়ান জেনিস ওয়াং ব্যাখ্যা করেন, “শব্দ আমাদের প্রত্যাশা পরিবর্তন করতে পারে, যা পছন্দের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।”
এছাড়াও, ঘরের রং এবং প্লেটের ডিজাইনও খাবারের স্বাদকে প্রভাবিত করে।
খাবার ভালো না লাগার পেছনে খারাপ অভিজ্ঞতারও ভূমিকা থাকে। কোনো খাবার খাওয়ার পর যদি ফুড পয়জনিং হয়, তবে সেই খাবারের প্রতি আমাদের বিতৃষ্ণা জন্মাতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে, আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যও খাদ্য পছন্দের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। কারো কারো মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু জিন থাকে, যা তাদের কিছু খাবারের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, অনেকের ধনে পাতার স্বাদ সাবানের মতো লাগে, যা একটি জিনগত পরিবর্তনের কারণে হতে পারে। বিজ্ঞানীরা সাদা ওয়াইন, বেকন বা শিকোরির প্রতি মানুষের পছন্দের সঙ্গেও কিছু জিনের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।
গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে খাদ্য বিতৃষ্ণা একটি সাধারণ ঘটনা। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীর ক্ষতিকর খাবার থেকে ভ্রূণকে রক্ষা করতে চায়, তাই কিছু খাবারের প্রতি তাদের অনীহা তৈরি হয়।
তবে, খাদ্য পছন্দের ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতিও প্রভাব ফেলে। এমন অনেক খাবার আছে যা একটি সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক, কিন্তু অন্য সংস্কৃতিতে হয়তো মানুষ তা গ্রহণ করতে চায় না।
তাহলে, অপছন্দের খাবারগুলো কি সত্যিই পছন্দের তালিকায় আনা সম্ভব? বিজ্ঞানীরা বলছেন, অবশ্যই সম্ভব।
কোনো খাবারের প্রতি ভালো লাগা তৈরি করতে হলে, সেই খাবারটিকে ইতিবাচক অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোনো খাবার খেলে, মস্তিষ্ক সেই স্বাদকে তৃপ্তির সঙ্গে যুক্ত করে।
এছাড়াও, একটি খাবারে অভ্যস্ত হতে বারবার সেই খাবারটি খাওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন।
ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেনের গবেষক ওয়াং-এর মতে, খাবারের প্রতি আমাদের ধারণা পরিবর্তন করতে হলে নতুন খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে এবং সেগুলোকে উপভোগ করার চেষ্টা করতে হবে।
সুতরাং, খাবারের প্রতি আমাদের ভালো লাগা বা খারাপ লাগা—এগুলো শুধু স্বাদ বা গন্ধের বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের শরীর, মন এবং পরিবেশের একটি জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফল।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক