পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের জেরে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাদের আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে, যা এক গভীর মানবিক সংকট তৈরি করেছে।
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (Associated Press) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজার। এদের মধ্যে অনেকে আশ্রয় খুঁজেছেন শরণার্থী শিবিরগুলোতে, স্কুলের হলঘরে কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে।
কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর কর্তৃপক্ষও এখন তাদের জায়গা ছাড়তে বলছে, কারণ তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য সেটি প্রয়োজন।
পশ্চিম তীরের একটি শহরের বাসিন্দা, পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, তাদের পরিবার কয়েক সপ্তাহ ধরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরছে। প্রথমে তারা একটি কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু সেখান থেকেও তাদের চলে যেতে বলা হয়েছে।
বাস্তুচ্যুত মানুষদের অনেকেই জানেন না তারা এখন কোথায় যাবেন। ইসরায়েলি বাহিনী কিছু ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে।
সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNRWA) তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। গাজায় চলমান সংকটের কারণে ইউএনআরওয়ার ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে পশ্চিম তীরে তাদের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে জানা যায়, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর এটি পশ্চিম তীরে সবচেয়ে বড় আকারের বাস্তুচ্যুতির ঘটনা।
ইসরায়েল বলছে, নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে তারা এই অভিযান চালাচ্ছে। তবে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা বলছেন, তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, তারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন অথবা ভাড়া করা বাসায় থাকছেন। তবে দরিদ্র মানুষেরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন।
রমজান মাস শেষ হওয়ার পর অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের জায়গা ছাড়তে বলা হচ্ছে।
পশ্চিম তীরের একটি শহরের গভর্নর আব্দুল্লাহ কামিল জানান, বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য তারা খালি ঘর ভাড়া করার চেষ্টা করছেন এবং তাদের জন্য অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করতে কিছু প্রিফেব্রিকেটেড কন্টেইনার আনার পরিকল্পনা করছেন।
বাস্তুচ্যুত হওয়া এক নারী জানান, ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইসরায়েলি সেনারা তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সময় মাত্র সাত মিনিট সময় দিয়েছিল জিনিসপত্র গোছানোর জন্য।
তারা সাদা পতাকা নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন, যাতে বোঝা যায় তারা কোনো হুমকি নন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকে মেঝেতে ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন এবং তাদের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবারও অভাব রয়েছে।
ওই নারী আরও জানান, সেনারা তাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় প্রায় ২,০০০ ডলার (বর্তমান বিনিময় হারে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার বেশি) চুরি করে নিয়ে যায়, যা তিনি সন্তানদের শিক্ষার জন্য বহু বছর ধরে জমিয়েছিলেন।
চিকিৎসা সহায়তা প্রদানকারী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিনিধি নিকোলাস পাপাচ্রিস্টোমউ জানান, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় তাদের চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সংস্থাটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিলেও, ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
ইউএনআরওয়া জানিয়েছে, তারা বাস্তুচ্যুত হওয়া সবচেয়ে অসহায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে প্রতি মাসে ২৬৫ ডলার (বর্তমান বিনিময় হারে প্রায় ৩০ হাজার টাকার বেশি) করে সহায়তা করার পরিকল্পনা করছে।
তবে তাদের কাছে এই পরিমাণ অর্থ সর্বোচ্চ তিন মাসের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
বাস্তুচ্যুত মানুষেরা বলছেন, তারা পরিত্যক্ত বোধ করছেন। রমজান মাসে স্থানীয়দের কাছ থেকে যে সাহায্য আসতো, সেটিও এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
অনেকের কর্মসংস্থানও বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ তারা ইসরায়েলে আগের মতো কাজ করতে পারছেন না।
সবমিলিয়ে, পশ্চিম তীরে বাস্তুচ্যুতির এই সংকট একটি গভীর মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। পর্যাপ্ত আশ্রয় ও সহায়তার অভাবে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস