ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন বিশেষ দূতের আকস্মিক অবস্থান পরিবর্তনের জেরে তেহরানের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।
এই ঘোষণার মাত্র ১২ ঘণ্টা আগেও তিনি ফক্স নিউজে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেসামরিক ব্যবহারের জন্য স্বল্পমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অনুমতি দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উইটকফের এই কঠোর পদক্ষেপের কারণে তেহরানের সঙ্গে আলোচনা কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
আলোচনার স্থান নিয়েও ঘটেছে পরিবর্তন। প্রথমে ওমানে আলোচনার কথা থাকলেও, পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ছিল ইতালিতে বৈঠকের আয়োজন করা হবে।
তবে শেষ পর্যন্ত ওখানেই আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উইটকফ তার বিবৃতিতে বলেন, “ইরানের সঙ্গে চুক্তি তখনই সম্পন্ন হবে, যখন এটি ট্রাম্পের চুক্তি হবে।
চূড়ান্ত চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার কাঠামো থাকতে হবে।
এর অর্থ হল ইরানকে অবশ্যই তাদের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ ও অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি বন্ধ করতে হবে।
আমরা এমন একটি কঠিন ও ন্যায্য চুক্তি করতে চাই যা স্থায়ী হবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাকে সেই কাজটিই করতে বলেছেন।”
এর আগে ফক্স নিউজে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উইটকফ বলেছিলেন, ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বেসামরিক পারমাণবিক কার্যক্রমের জন্য ৩.৬৭ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে তারা ৬০ শতাংশ এবং অন্য ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করছে।
এটি হতে পারে না।
তাদের দাবি অনুযায়ী, ৩.৬৭ শতাংশের বেশি সমৃদ্ধ করে বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি চালানোর প্রয়োজন নেই।
এই আলোচনা মূলত সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এবং অস্ত্র তৈরির যাচাইকরণের ওপর জোর দেবে।
এর মধ্যে তারা কী ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ করেছে এবং বোমা তৈরির উপাদানগুলোও যাচাই করা হবে।
উইটকফের দুটি ভিন্ন অবস্থান কার্যত মেলানো কঠিন।
বিশ্লেষকদের মতে, তিনি হয়তো একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির কথা বলছেন, যেখানে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে বেসামরিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে।
আর চূড়ান্ত চুক্তিতে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার কথা বলা হয়েছে।
আবার এমনও হতে পারে যে, ট্রাম্প সম্ভবত ইরানের বিষয়ে কঠোর নীতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কর্মকর্তাদের চাপের মুখে পড়েছেন।
এই কর্মকর্তাদের আশঙ্কা ছিল, উইটকফের আলোচনার অবস্থান কার্যত ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করবে, যেখান থেকে ২০১৮ সালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন এবং চুক্তিটিকে অকার্যকর বলেছিলেন।
উইটকফের এই অবস্থান পরিবর্তন পররাষ্ট্রনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
কারণ, অনেক সময় দেখা যায়, প্রশাসনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মতবিরোধ দেখা যায় এবং প্রেসিডেন্ট হয়তো নীতিগত বিষয়গুলো সেভাবে মনোযোগ দেন না, অথবা তার পক্ষ থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি অবগত নন।
উল্লেখ্য, স্টিভ উইটকফের কোনো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই।
তাকে গাজা, ইউক্রেন এবং ইরানের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি নিজেকে সব সময় ট্রাম্পের বার্তাবাহক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, ওমান এবং ফক্স নিউজে তিনি যে প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলো আসলে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুযায়ীই ছিল।
ইরান বরাবরই তাদের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার অধিকারের কথা বলে আসছে।
ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন অবস্থানে তেহরান হতাশ হবে এবং কঠোরপন্থীদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে।
তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থা রাখা যায় না।
সম্প্রতি, তেহরানে একটি বিরল ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছিল যে, উইটকফ এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির মধ্যে আলোচনায় কিছু মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে পারে।
যা গত এক দশকের মধ্যে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা যাচ্ছিল।
জাতিসংঘের পারমাণবিক পরিদর্শক সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসিও চলতি সপ্তাহে ইরান পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
সেখানে তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার বাড়ানোর বিষয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান