ওকলাহোমা সিটি বোমা হামলার ৩০ বছর, শোক আর উদ্বেগের ছবি।
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে, ১৯৯৫ সালের ১৯শে এপ্রিল, আমেরিকার বুকে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। ওকলাহোমা শহরের একটি ফেডারেল ভবনে বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১৬৮ জন নিরীহ মানুষ। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলা। এই ঘটনার স্মৃতি আজও অনেকের মনে গভীর ক্ষত হয়ে আছে।
বোমা হামলায় নিহতদের মধ্যে ছিলেন এক সদ্যোজাত শিশু, যিনি মায়ের কোল থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন। ছিলেন এমন একজন, যিনি বাবাকে দেখার সুযোগ পাননি। আবার কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়ে আজও স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারেন না। এই ভয়াবহ ঘটনা আজও তাদের জীবনে দুঃসহ স্মৃতি হয়ে আছে।
বোমা হামলাটি চালিয়েছিল দুই প্রাক্তন মার্কিন সেনা সদস্য, যাদের সরকার বিরোধী চরমপন্থী ধারণা ছিল। টেক্সাসের ওয়াকোতে ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান সম্প্রদায়ের উপর রক্তাক্ত অভিযান এবং আইডাহোর রুবি রিজের ঘটনার জের ধরে তাদের মধ্যে এই বিদ্বেষ জন্ম নেয়।
এই বোমা হামলার পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল গোটা বিশ্ব। কিন্তু যারা সরাসরি এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আজও উদ্বেগে দিন কাটান। তাদের ভয়, আজকের দিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা আবারও সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।
ওকলাহোমা সিটি ন্যাশনাল মেমোরিয়াল জাদুঘরের মাঠে আগামী ১৯শে এপ্রিল এই হামলার ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে।
ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যু, মায়ের আর্তনাদ।
বেলি আলমন নামের একটি শিশু, বোমা হামলার আগের দিনই তার প্রথম জন্মদিন পালন করেছিল। পরদিন সকালে, মা আরেন আলমন তাকে আলফ্রেড পি. মুরার ফেডারেল ভবনের ভেতরের ‘আমেরিকা’স কিডস ডে কেয়ার’-এ রেখে এসেছিলেন। এরপর আরেন তার প্রথম সন্তানকে জীবিত দেখেননি।
পরের দিন স্থানীয় একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় তিনি একটি ছবি দেখেন। ছবিতে দেখা যায়, ফায়ারফাইটার ক্রিস শিল্ডস-এর কোলে নিথর অবস্থায় রয়েছে বেইলির শরীর।
আরেন বলেন, “আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছিলাম, ওটা বেইলি। আমি আমার ডাক্তারকে ফোন করে খবরটা নিশ্চিত করি।”
সেই হৃদয়বিদারক ছবিটি তুলেছিলেন একজন অপেশাদার চিত্রগ্রাহক। ১৯৯৬ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছিলেন। ছবিতে ফায়ারফাইটার ক্রিস শিল্ডস যেন সেদিনকার উদ্ধারকর্মীদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, আর বেইলি ছিল সেই দিনের নিহত শিশুদের প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু আরেনের কাছে, তার মেয়ে কোনো প্রতীক ছিল না।
আরেন বলেন, “আমি জানি, ছবিটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে আমি বুঝি, বেইলি একজন সত্যিকারের মানুষ ছিল। সে শুধু একটি প্রতীক ছিল না, আর আমার মনে হয়, এই বিষয়টি অনেকেই ভুলে যায়।”
আলোচনায় আসা এক ফায়ারফাইটার।
ছবি তোলার সময় ফায়ারফাইটার ক্রিস ফিল্ডস ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি জানান, একজন পুলিশ অফিসার এসে তার হাতে বেইলির নিথর দেহ তুলে দেন।
ফিল্ডস শিশুটির শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাননি।
তিনি বলেন, “আমি বেইলির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ‘আজকে কারো জীবন একেবারে এলোমেলো হয়ে যাবে।’”
ফিল্ডস এখন রাজনীতি থেকে দূরে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটান। তবে তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক আদর্শের কারণে আবারও এমন হামলা হতে পারে।
তিনি বলেন, “আমি এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না, তবে আমার মনে হয়, এমন ঘটনা আবার ঘটতে পারে।”
ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়া এক শিশু।
পি.জে. অ্যালেন নামের এক শিশু, বোমা হামলায় আহতদের মধ্যে অন্যতম। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ মাস। বোমা হামলায় তার শরীরের অর্ধেকের বেশি পুড়ে গিয়েছিল, একটি ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং মাথার আঘাত লেগেছিল। এছাড়া, কণ্ঠনালীর ক্ষতি হওয়ায় তার কথা বলতেও অসুবিধা হয়।
বর্তমানে ওকলাহোমা সিটির একটি বিমানঘাঁটিতে তিনি টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন। অ্যালেন জানান, শরীরের চামড়ার ক্ষতির কারণে তাকে দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে হয়নি এবং দিনের বেলা বাইরে বের হওয়াও তার জন্য কঠিন ছিল।
বোমা হামলার প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার মধ্যে কোনো দুঃখ দেখা যায় না।
তিনি বলেন, “এপ্রিল মাস এলেই আমি অনুভব করি, প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠাটা কত বড় একটা পাওয়া। আমি জানি, অনেকের কপালে হয়তো এত সৌভাগ্য ছিল না।”
বাবাকে না দেখা এক ছেলের গল্প।
অস্টিন অ্যালেন নামের এক যুবক, যিনি বোমা হামলায় নিহত টেড এল. অ্যালেনের ছেলে। ঘটনার সময় অস্টিনের বয়স ছিল মাত্র চার বছর। বাবার সঙ্গে কাটানো অল্প কিছু মুহূর্তের স্মৃতি ছাড়া, বাবার সম্পর্কে তার তেমন কিছুই মনে নেই।
অস্টিন বলেন, “বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কাছ থেকে শোনা গল্পগুলোই বাবার প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে।”
আজ যখন তার নিজের একটি চার বছরের সন্তান রয়েছে, তখন বর্তমান সময়ের সরকার বিরোধী মানসিকতা তাকে চিন্তায় ফেলে।
তিনি বলেন, “আজকের পরিস্থিতিও অনেকটা তেমনই। একদিকে যেমন একটি পক্ষ, তেমনই অন্য দিকে আরেকটি পক্ষ। ১৯৯৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে আজকের অনেক মিল রয়েছে।”
কর্মীর জীবন বদলে গিয়েছিল এক মুহূর্তে।
ড্যানিস পিউরিফয় নামের এক ব্যক্তি, যিনি ফেডারেল ভবনের নিচতলায় অবস্থিত সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসের সহকারী ব্যবস্থাপক ছিলেন। বোমা হামলায় তার ১৬ জন সহকর্মী এবং অফিসে আসা ২৪ জন গ্রাহক নিহত হয়েছিলেন।
বিস্ফোরণের শব্দ তিনি শোনেননি, যা অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর ক্ষেত্রেই ঘটেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, তার কম্পিউটারে হয়তো বিস্ফোরণ ঘটেছে।
পিউরিফয় বলেন, “পরে আমি বুঝতে পারি, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মন কীভাবে কাজ করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের দেশ আজও অনেক ক্ষেত্রে সরল এবং যারা চরমপন্থী, সরকার বিরোধী মনোভাব পোষণ করে, তাদের সংখ্যাও কম নয়। আমি সবাইকে বলি, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মানুষকে হত্যা করতে পারে, আর আমরা এখানে সেটাই দেখেছি।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস