চীনের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ আমেরিকার অস্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির জন্য এক নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। এর কারণ হল, অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে প্রয়োজনীয় বিরলminerals-এর সরবরাহ কমে যাওয়া।
এই খনিজগুলির জন্য তারা প্রধানত চীনের উপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, চীন সরকার সাত ধরনের বিরলminerals-এর রপ্তানির উপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
এই পদক্ষেপের ফলে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে সাবমেরিন বা ড্রোন—এমন অনেক সামরিক সরঞ্জামের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS) নামক একটি গবেষণা সংস্থা এই বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের থিংক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসও একই ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। তাদের মতে, চীন যদি ভবিষ্যতে এই ধরনের বিধিনিষেধ আরও বাড়ায়, তাহলে তা আমেরিকার প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে।
শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুনরায় শিল্পায়ন করার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাতেও বাধা সৃষ্টি করবে। এই মুহূর্তে, চীন বিশ্বে ব্যবহৃত বিরলminerals-এর ৭০ শতাংশ উত্তোলন করে এবং প্রায় ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ করে।
এই কারণে আমেরিকার সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুতকারকদের জন্য চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ। এই পরিস্থিতিতে, চীন যদি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে তা আমেরিকার সামরিক সক্ষমতার উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
কারণ, এই বিরলminerals-এর অভাবে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামের উৎপাদন সম্ভব নয়। F-35 যুদ্ধবিমান, ভার্জিনিয়া ও কলম্বিয়া শ্রেণির সাবমেরিন, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, প্রিডেটর ড্রোন—এমন অনেক অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামে এই খনিজগুলি ব্যবহৃত হয়।
যদিও চীন সরাসরি এই খনিজগুলির রপ্তানি বন্ধ করেনি, তবে লাইসেন্সিং-এর মাধ্যমে তারা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। অতীতে, ২০১২ সালে জাপানের সঙ্গে এমন একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গিয়েছিল, যখন চীন বিরলminerals-এর রপ্তানি বন্ধ করে দেয় এবং এর ফলে বাজারে এই খনিজগুলির দাম দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
আমেরিকা অবশ্য বিকল্প উৎসের সন্ধান করছে। তারা ইউক্রেন এবং গ্রিনল্যান্ড থেকে এই খনিজগুলি সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তবে, এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি এবং ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ডকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি আমেরিকার জন্য দীর্ঘমেয়াদে উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
কারণ, সামরিক প্রযুক্তির দৌড়ে চীন ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, যদি চীন বিরলminerals-এর সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে আমেরিকার সামরিক সক্ষমতা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
একইসঙ্গে, চীন সেমিকন্ডাক্টর এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও আমেরিকার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে, চ্যাথাম হাউসের গবেষক উইলিয়াম ম্যাথিউস বলেছেন, “চীন এখন সরবরাহ শৃঙ্খলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
এর ফলস্বরূপ, সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে বিমান নির্মাণ—এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে আমেরিকার একচেটিয়া আধিপত্য কমে যেতে পারে।” অন্যদিকে, বেসামরিক শিল্পেও বিরলminerals-এর অভাব একটি উদ্বেগের বিষয়।
উদাহরণস্বরূপ, টেসলার মতো সংস্থা তাদের বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন কমাতে এই খনিজগুলির ব্যবহার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর চেষ্টা করছে। সুতরাং, চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধ কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামরিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইকে আরও তীব্র করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব অর্থনীতির এই ধরনের পরিবর্তনগুলি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান