যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত হওয়া এক ‘বিশেষজ্ঞ’ নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। সম্প্রতি, দেশটির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মনোবিদ হিসেবে পরিচিত বারবারা স্যান্টিনি নামের এক ব্যক্তির যোগ্যতা ও পরিচিতি নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর মানসিক প্রভাব থেকে শুরু করে ভিটামিন ডি-এর প্রয়োজনীয়তা কিংবা কীভাবে ডার্ট খেলা স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে—এমন নানা বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে মতামত দিয়েছেন।
তবে, তার দেওয়া বক্তব্যগুলো এখন সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কারণ, স্যান্টিনির প্রকৃত পরিচয় এবং তার দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকী, তার সম্পূর্ণ পরিচয়টাই সাজানো কিনা, সেই বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিষয়টি সংবাদ সংস্থাগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে, ভুয়া বিশেষজ্ঞরা তৈরি করা অনেক সহজ হয়ে গেছে, যা তাদের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। স্যান্টিনির মন্তব্যগুলো ভোগ, মেট্রো, কসমোপলিটান, আই নিউজপেপার, এক্সপ্রেস, হ্যালো!, টেলিগ্রাফ, ডেইলি স্টার, ডেইলি মেইল এবং সান-এর মতো প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি বিবিসি-র আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটেও তার উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনলাইনে সেক্স টয় বিক্রেতা ‘পিচেস অ্যান্ড স্ক্রিমস’-এর ওয়েবসাইটে তিনি সেক্স ও সম্পর্ক বিষয়ক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। তার যোগ্যতা হিসেবে সেখানে ‘মনোবিদ এবং সেক্স বিষয়ক পরামর্শদাতা—অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’ উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও, ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটি (বিপিএস) জানিয়েছে, তিনি তাদের সদস্য নন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তার কোনো সক্রিয় উপস্থিতি নেই।
বারবারা স্যান্টিনি বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলে প্রেস গেজেট। পিচেস অ্যান্ড স্ক্রিমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করা হয়, কিন্তু পরিচয় নিশ্চিত করা বা তার যোগ্যতার প্রমাণ চেয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অবশেষে, একটি বার্তা পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়, “বিষয়টিতে আগ্রহ দেখানোর জন্য ধন্যবাদ।” এর বেশি কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
যেসব সাংবাদিকরা তার বক্তব্য ব্যবহার করেছেন, তাদের কয়েকজন জানিয়েছেন, তারা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে তার মন্তব্য পেয়েছেন। এদের মধ্যে ‘রেসপন্সসোর্স’ নামের একটি সংস্থার নামও জানা যায়। বর্তমানে, ওই সংস্থাটি ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং স্যান্টিনিকে সহায়তা করা জনসংযোগ সংস্থাকেও স্থগিত করেছে। এছাড়াও, বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন করার জন্য তারা একটি নতুন পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা করছে, যেখানে সাংবাদিকরা তাদের ব্যবহৃত বিশেষজ্ঞের বিষয়ে মতামত দিতে পারবেন।
যুক্তরাজ্যের অনেকগুলো সংবাদমাধ্যম তাদের প্রকাশিত খবর থেকে স্যান্টিনির নাম সরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ডেইলি স্টার-এর একটি প্রতিবেদনে, ডার্ট খেলার মাধ্যমে কীভাবে মনকে পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি এবং সমস্যা সমাধানের মতো গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করে, সেই বিষয়ে স্যান্টিনির মতামত ছিল। ডেইলি মিরর-এর একটি প্রতিবেদনেও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে তার মন্তব্য ছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন, এই মহামারীর কারণে অনেকে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে বা সামাজিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকতে সমস্যা অনুভব করছেন। বিবিসি তাদের একটি প্রতিবেদনে এআই বিষয়ক আলোচনায় স্যান্টিনির মন্তব্য ব্যবহার করেছিল, যা তারা সরিয়ে নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের তথ্যের সত্যতা যাচাই করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আরো বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, এআই-এর এই যুগে, যেখানে ভুয়া তথ্য ছড়ানো অনেক সহজ। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস-এর সাংবাদিকতা ও এআই প্রকল্পের প্রধান চার্লি বেকেট বলেন, “আসলে, এখানে এআই-এর কোনো দোষ নেই। কিছু অসাধু লোক এই সুযোগ নিচ্ছে। এটা আমাদের সবার জন্য একটা সতর্কবার্তা।
ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট রোমান রাজকা বলেছেন, “ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির মতো একটি পেশাদার সংস্থার সঙ্গে কাজ করলে সাংবাদিকদের মনে এই বিষয়ে কোনো দ্বিধা থাকে না যে, তারা একজন প্রকৃত মানুষের সঙ্গেই কথা বলছেন।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান