মস্তিষ্কের এক বিশেষ ক্ষমতা: ম্যারাথন দৌড়ের সময় শরীরে শক্তি যোগায় মায়লিন
দীর্ঘ সময় ধরে দৌড়ানোর ধকল সামলাতে আমাদের মস্তিষ্ক যে কতখানি শক্তিশালী, সম্প্রতি এক গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে।
খেলাধুলা বা অন্য কোনো শারীরিক পরিশ্রমের সময় মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে এর নিজস্ব কৌশল রয়েছে। মানুষের মস্তিষ্কের এই বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে নতুন তথ্য দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
ইউনিভার্সিটি অফ দ্য বাস্ক কান্ট্রির নিউরোলজিস্ট কার্লোস মাতুতের নেতৃত্বে একদল গবেষক ‘নেচার মেটাবলিজম’ জার্নালে তাঁদের গবেষণা প্রকাশ করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যারাথন দৌড়ের মতো দীর্ঘ সময় ধরে চলা শারীরিক কসরতের সময় যখন শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা যায়, তখন মস্তিষ্ক তার নিজস্ব ‘মায়লিন’ নামক উপাদান ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে।
মায়লিন হলো স্নায়ু কোষের চারপাশে থাকা ফ্যাট জাতীয় আবরণ, যা ইনসুলেটরের মতো কাজ করে।
গবেষকরা ১০ জন দৌড়বিদের ওপর এমআরআই স্ক্যান করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
দৌড় শুরু করার আগে এবং দৌড় শেষ করার পর তাঁদের মস্তিষ্কের ছবি তোলা হয়। এর কয়েক সপ্তাহ পরে, তাঁদের মস্তিষ্ক পুনরায় স্ক্যান করা হয়।
পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ম্যারাথন শেষ হওয়ার পর দৌড়বিদদের মস্তিষ্কের কিছু অংশে মায়লিনের পরিমাণ কমে গিয়েছিল।
এই অংশগুলো মূলত মোটর কো-অর্ডিনেশন, সংবেদী অঙ্গ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত।
তবে, দৌড়ের কয়েক সপ্তাহ পর মায়লিনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, শরীরে জলের অভাব বা ডিহাইড্রেশন এর কারণ নয়।
বরং, মস্তিষ্কের নিজস্ব কৌশল হলো—গ্লুকোজের অভাবে মায়লিনকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা।
যখন শরীরে গ্লুকোজ সরবরাহ কমে যায়, তখন মস্তিষ্ক তার কাছে যা আছে, তাই ব্যবহার করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে, নিউরনের জন্য সেটি হলো মায়লিন।”
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের বয়স ছিল ৪৫ থেকে ৭৩ বছরের মধ্যে।
এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম।
আমরা হয়তো অনেকেই এটা জানতাম না যে, ম্যারাথন দৌড়ের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের মস্তিষ্কের গঠন এত দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে।”
তবে, এই পরিবর্তনের কারণে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মায়লিনের এই ব্যবহার ক্ষণস্থায়ী এবং সম্ভবত স্বাস্থ্যকরও।
নিয়মিত শরীরচর্চা করলে মায়লিনের বিপাক ক্রিয়াও সক্রিয় থাকে।
দৌড়ানোর আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে, যা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়মিত দৌড়ালে মস্তিষ্কে ডোপামিন, সেরোটোনিন এবং নোরএপিনেফ্রিনের মতো কিছু রাসায়নিকের নিঃসরণ বাড়ে, যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করে এবং উদ্বেগ ও হতাশাকে কমাতে সাহায্য করে।
দৌড়বিদদের মধ্যে যে ‘রানার্স হাই’ দেখা যায়, তার কারণ হলো মস্তিষ্কের ক্যানাবিস-এর মতো উপাদান, যা এন্ডোকানাবিনয়েডস নামে পরিচিত।
নিয়মিত শরীরচর্চা মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে নতুন নিউরনের জন্ম দেয়, যা স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
এমনকি, দীর্ঘ সময় ধরে দৌড়ালে স্মৃতিভ্রংশতার মতো সমস্যা থেকেও মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
তবে, অতিরিক্ত ব্যায়াম বা ‘ওভারট্রেনিং’ শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
অতিরিক্ত ব্যায়ামের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং পারফর্মেন্স কমে যায়।
অনেক সময় গুরুতর আঘাতও লাগতে পারে।
এর পাশাপাশি, এটি মস্তিষ্কের উপরও খারাপ প্রভাব ফেলে।
অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের কারণে মন খারাপ হওয়া, ক্লান্তি অনুভব করা বা বিরক্ত লাগার মতো সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে।
ডিউকিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লুয়ানা মেইন জানিয়েছেন, অতিরিক্ত প্রশিক্ষণে মনোযোগ কমে যাওয়ার কারণে মানুষ ভুল করে এবং আহত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের প্রয়োজন।
যারা দৌড়ানো বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁদের আমি বলব—নিয়মিত ব্যায়াম করুন, তবে সঠিক পদ্ধতিতে।”
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক