শিরোনাম: নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যে ঢুকছে রাশিয়া ও বেলারুশের কাঠ, গবেষণায় উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুতর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে আসা কাঠ, যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তা এখনো অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রবেশ করছে। এই তথ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বচ্ছতা এবং পরিবেশগত সুরক্ষার প্রশ্নগুলিকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
বিশ্ব বন শনাক্তকরণ সংস্থা (World Forest ID) সহ বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। তারা প্রধানত কাঠের উৎস সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন সার্টিফিকেশন স্কিমের সত্যতা যাচাই করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রধান টেকসই স্কিম, যেমন—ফরেস্ট স্টুয়ার্ডশিপ কাউন্সিল (FSC) এবং প্রোগ্রাম ফর দ্য এন্ডোর্সমেন্ট অফ ফরেস্ট সার্টিফিকেশন (PEFC) দ্বারা প্রত্যয়িত প্রায় অর্ধেক বার্চ কাঠের উৎপত্তিস্থল ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বার্চ কাঠ আসবাবপত্র, কিচেন প্যানেল এবং বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
গবেষণায় ব্যবহৃত কাঠগুলো মূলত ইউক্রেন, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়া থেকে এসেছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু কাঠের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করার পর দেখা গেছে, ৪৬ শতাংশ নমুনার উৎপত্তিস্থল লেবেলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কাঠ রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে আসার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে রাশিয়ার কাঠ ও কাঠের তৈরি সামগ্রী আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য বিষয়ক সংগঠন, টিমবার ডেভেলপমেন্ট ইউকের প্রধান নির্বাহী ডেভিড হপকিন্স বলেন, “অন্য কোথা থেকে এই কাঠ আসতে পারে?” তিনি আরও যোগ করেন, “ফিনল্যান্ডে উৎপাদিত বার্চ কাঠ কিছু করাতকলে প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে। বাল্টিক ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অংশেও এর উৎপাদন হয়। তবে কাঠের প্রধান অংশটি রাশিয়া থেকে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যা রাশিয়ার অর্থনীতিতে সরাসরি সহায়তা করছে এবং নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন।”
কাঠের সার্টিফিকেশন স্কিমগুলি বন ব্যবস্থাপনার টেকসই উন্নয়নের জন্য এবং বনভূমি ধ্বংস প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এই গবেষণায় সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ব বন শনাক্তকরণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জেড স্যান্ডার্স বলেছেন, “যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা এবং বাণিজ্য আইন ও সার্টিফিকেশন স্কিমের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তবে এগুলো বাস্তবায়নের সরঞ্জামগুলির ওপর এর কার্যকারিতা নির্ভর করে। রাসায়নিক ট্রেসেবিলিটি আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে কী আছে, সে সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়।”
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে রাশিয়ার বার্চ কাঠের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। তবে, এরপর কাজাখস্তান ও তুরস্কের মতো দেশগুলো থেকে কাঠের রপ্তানি অনেক বেড়ে যায়। জাতিসংঘের বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কাজাখস্তান থেকে কাঠের তৈরি প্লাইউডের রপ্তানি ২০২১ সালের ৬০০ টন থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ২৬ হাজার টনে পৌঁছেছে।
পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা আর্থসাইটের পরিচালক স্যাম লসন বলেছেন, “কাঠ রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল, যা যুদ্ধের আগে দেশটির রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে কাঠ ও কাঠের তৈরি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের তদন্তে দেখা গেছে, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার পর থেকে ১.৫ বিলিয়ন ইউরোর বেশি মূল্যের অবৈধ কাঠ ইউরোপে প্রবেশ করেছে।”
যুক্তরাজ্যের সরকার জানিয়েছে, তারা নিশ্চিত করতে চায় যে, যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করা কাঠ অবশ্যই বৈধ এবং টেকসই হবে। তারা সার্টিফিকেশন স্কিমগুলোকে আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে আইনের কোনো লঙ্ঘন হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
এই ঘটনার জেরে বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা হলো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কাঠের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে উৎস সনাক্তকরণ এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে কোনোভাবেই অবৈধ বা টেকসই নয় এমন কাঠ দেশের বাজারে প্রবেশ করতে না পারে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান