মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম ১০০ দিনে সরকারের কর্মদক্ষতা বিষয়ক একটি বিশেষ বিভাগ (Department of Government Efficiency) বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই বিভাগের নেতৃত্বে ছিলেন প্রযুক্তি বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এলন মাস্ক।
এই বিভাগের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি ব্যয় কমানো এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে ট্রাম্প প্রশাসনের ইচ্ছানুযায়ী ঢেলে সাজানো। তবে, তাদের কাজের ধরন এবং কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে এটি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছে।
এলন মাস্কের নেতৃত্বে গঠিত এই বিশেষ বিভাগটি মূলত তরুণ প্রযুক্তিবিদ ও কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের একটি দল নিয়ে গঠিত হয়েছিল। তারা সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় প্রবেশ করে ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে।
এক্ষেত্রে তারা কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম ও ফেডারেল আইনও লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারি চুক্তি বাতিল, বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ বন্ধ করা এবং কিছু সংস্থার বিলুপ্তি ঘটানো তাদের প্রধান কাজ ছিল।
এই বিভাগ ফেডারেল সরকারের অত্যন্ত স্পর্শকাতর কিছু সিস্টেমে প্রবেশ করে, যেগুলোর মাধ্যমে ট্রিলিয়ন ডলারের সরকারি অর্থ লেনদেন হয় এবং যেখানে কয়েক কোটি আমেরিকান নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষিত থাকে।
এছাড়া, এই বিভাগের কারণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে এক লক্ষেরও বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে, যাদের মধ্যে স্বাস্থ্য, বৈদেশিক সাহায্য, কূটনীতি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাও ছিলেন।
এলন মাস্ক নিজে প্রায়ই এই বিভাগের কার্যক্রমের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করতেন, যদিও সেগুলোর মধ্যে কিছু ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য ছিল। ট্রাম্পের প্রথম ১০০ দিনে, মাস্ককে প্রায়ই সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে দেখা গেছে।
এমনকি তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে যৌথ সাক্ষাৎকারেও অংশ নিয়েছিলেন এবং টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও তার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল।
তবে রাজনৈতিক চাপ, ট্রাম্প মন্ত্রিসভার সঙ্গে মতবিরোধ এবং নিজের বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি ‘টেসলা’র কিছু সমস্যার কারণে মাস্ক ঘোষণা করেন যে তিনি এই বিভাগের কাজ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসবেন। যদিও তিনি জানিয়েছেন, তিনি সপ্তাহে এক-দুদিন এই বিভাগের জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাস্ক সরে গেলেও তার বিভাগের ডজন খানেক সহযোগী এখনো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। ফলে, মাস্কের অনুপস্থিতিতেও এই বিভাগের ব্যয় সংকোচনের নীতি সম্ভবত বহাল থাকবে।
ইতিমধ্যে, এই বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটরা এই বিভাগ এবং এর প্রধান এলন মাস্ককে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এমনকি আসন্ন নির্বাচনেও তারা এই ইস্যুকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
উদাহরণস্বরূপ, উইসকনসিনের একটি স্থানীয় নির্বাচনে মাস্কের অর্থায়নে একটি রক্ষণশীল দলের প্রার্থীকে সমর্থন করা হয়। তবে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেন। বিরোধীরা মনে করেন, মাস্কের এই হস্তক্ষেপ তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে।
বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভাগুলোতে এই বিভাগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, ব্যয় সংকোচনের নামে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পরিষেবাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি ২০০৯ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন বারাক ওবামার স্বাস্থ্য বীমা সংস্কারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল দলগুলো একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হয়েছিল।
তবে, রিপাবলিকান দলের আইনপ্রণেতারা এখনো পর্যন্ত ট্রাম্প এবং মাস্কের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। যদিও তারা স্বীকার করেছেন যে, এই বিভাগের কিছু সিদ্ধান্তের কারণে অনেকে অসন্তুষ্ট।
শুরুতে মাস্ক ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সরকারের প্রায় ৬.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট থেকে ২ ট্রিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারবেন। পরে তিনি এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনেন।
তবে, বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় হয়নি।
এই বিভাগ বিভিন্ন চুক্তি বাতিল, লিজ ও কন্ট্রাক্ট পুনর্বিবেচনা, অনুদান বন্ধ, কর্মীদের ছাঁটাই এবং বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও বিধি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু সমালোচকদের মতে, এই হিসাবের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তি বাতিলের ফলে সরকারের সরাসরি কোনো সাশ্রয় হয় না। কারণ অব্যবহৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট সংস্থাতেই ফেরত যায়। এরপর সেই সংস্থা কংগ্রেসের কাছে অন্য কোনো খাতে অর্থ ব্যবহারের অনুমতি চাইতে পারে অথবা হোয়াইট হাউস আইনপ্রণেতাদের কাছে ওই অর্থ ফেরত চেয়ে প্রস্তাব দিতে পারে।
বর্তমানে, এই বিভাগের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া শতাধিক মামলার ফলাফল কী হয়, সেদিকে সবার দৃষ্টি রয়েছে। এসব মামলায় বিভিন্ন সংস্থার বিলুপ্তি, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগ (IRS), ট্রেজারি বিভাগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর ডেটা ব্যবহারের অধিকার সহ বিভিন্ন বিষয় চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের ব্যয় কমানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যখাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সংস্কার আনা প্রয়োজন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন