মা, তুমি আমার আকাশে সূর্যের মতো—কথাটি যেন কানে বাজছে এখনো। জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মা ডেবোরা ফিঙ্কের কথাগুলো ভোলবার নয় তাঁর মেয়ে, ক্যাটরিনা ফিঙ্কের।
ক্যানসারের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে অবশেষে গত বছর, ২০২৫ সালের ১৪ই জানুয়ারি, মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তিনি পাড়ি দেন অনন্তলোকে।
ডেবোরা, যিনি টিকটকে তাঁর জীবন, পরিবার, ভালোবাসা এবং ক্যান্সার থেকে পাওয়া শিক্ষা নিয়ে কথা বলতেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ৮ লক্ষাধিক মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
২০২০ সালের মার্চ মাসে ডেবোরা জানতে পারেন যে তিনি বিরল প্রকৃতির এক ক্যান্সার, ‘লেইওমায়োসারকোমা’য় আক্রান্ত। এরপর কেটেছে তাঁর পরিবারের সঙ্গে কাটানো পাঁচটি বছর।
স্বামী পল এবং তিন জোড়া জমজ সন্তান—আলেক্স ও আমান্ডা (২৯), ক্যাটরিনা ও স্টিভেন (২৪), ডেভিড ও ড্যানিয়েলের (২৩) ভালোবাসায় সবসময় তিনি ছিলেন পরিবেষ্টিত।
ক্যাটরিনার অনুপ্রেরণাতেই ডেবোরা জীবনের শেষ দিনগুলোতে অনলাইনে নিজের কথা বলতে শুরু করেন।
মায়ের মৃত্যুর পর ক্যাটরিনা আজও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়, তাঁর তৈরি করা অনেক ভিডিওতে মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ দেখা যায়।
মা দিবস উপলক্ষে ক্যাটরিনা জানান, তাঁর মা শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকলেও, তাঁরা সকলে মিলে বাবার সঙ্গে আগের মতোই দিনটি উদযাপন করবেন, যেভাবে ডেবোরা চাইতেন।
“আমরা একসঙ্গে সময় কাটাব, তাঁর কথা বলব এবং এমন কিছু করব যা দেখে তিনি গর্বিত হতেন,”
ক্যাটরিনা তাঁর মায়ের কথা বলতে গিয়ে জানান, ডেবোরা ছিলেন মিশুক প্রকৃতির মানুষ, সবার সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারতেন।
এলিভেটরে দেখা হওয়া মানুষের সঙ্গেও তিনি বন্ধু হয়ে যেতেন।
ক্যাটরিনার মনে আছে, মা সবসময় চেয়েছেন তাঁর জীবন সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে, আর জীবনের শেষ সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া তাঁর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছিল।
ক্যানসারের কারণে যখন তাঁর পক্ষে বাইরে যাওয়া, রান্না করা বা ভালোবাসার কাজগুলো করা কঠিন হয়ে পড়েছিল, টিকটক ভিডিও তৈরি করাটা তাঁকে ব্যস্ত রেখেছিল, আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল।
মা ও মেয়ের এই জুটি সবসময় একসঙ্গে ভালো কাজ করেছেন।
ক্যাটরিনার মডেলিং ও অভিনয়ের সময় মা ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা।
তিনি ক্যাটরিনাকে সবসময় সহযোগিতা করেছেন।
মা ক্যামেরার সামনে হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসতেন।
ক্যাটরিনার মনে হয়, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁর মা যেন তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ক্যাটরিনা যখন মাকে তাঁর গল্প টিকটকে শেয়ার করতে উৎসাহিত করেন, তখন তিনি নিজে ‘ডগ-মম ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁর ১ লক্ষ ৩০ হাজার ফলোয়ার ছিল।
তিনি জানতেন, মায়ের কথাগুলো বহু মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলবে।
২০২০ সালে রোগ নির্ণয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, ডেবোরা কখনোই বিশ্বাস করতে চাননি যে তিনি মারা যাবেন।
কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি ইতিবাচক ছিলেন।
ক্যাটরিনা জানান, তিনি প্রায়ই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন।
অক্টোবর মাসে তিনি যখন মায়ের সঙ্গে ছিলেন, তখনই মা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হওয়া শুরু করেন।
নিজের জীবনের সত্য ঘটনাগুলো তুলে ধরে তিনি অন্যদেরও জীবনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন।
ক্যাটরিনা বলেন, টিকটক ভিডিও তৈরি করাটা মা ও মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে এক আনন্দদায়ক বিষয় ছিল।
হাসপাতালে বা বাড়িতে—যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা একসঙ্গে ভিডিও বানিয়েছেন, হাসি-ঠাট্টা করেছেন, দর্শকদের সঙ্গে বন্ধুর মতো কথা বলেছেন।
নভেম্বরে মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে।
হাসপাতালে থাকাকালীন তাঁরা একসঙ্গে কিছু বিশেষ মুহূর্ত তৈরি করেন।
ক্যাটরিনা ও তাঁর ভাই-বোনেরা মাকে কিছু প্রশ্ন করেন এবং তাঁর উত্তরগুলো রেকর্ড করেন।
মা তাঁর প্রিয় স্মৃতিগুলো তাঁদের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
এরপর তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে।
শ্বাস নিতে কষ্ট এবং ক্রমাগত কাশির কারণে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁরা আর কিছু করতে পারবেন না।
তাঁরা ডেবোরাকে ‘হসপিসে’ যাওয়ার পরামর্শ দেন।
কিন্তু ডেবোরা তাতে রাজি হননি।
তিনি বলেছিলেন, তিনি অন্য উপায় খুঁজবেন।
অবশেষে, ২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর, তিনি বাড়িতে ‘হসপিসে’ যান।
ক্যাটরিনা জানান, তিনি সবসময় মায়ের পাশে ছিলেন, তাঁর দেখাশোনা করেছেন।
শেষ সময়ে ডেবোরার কোনো বিশেষ ইচ্ছেরা ছিল না, তবে তিনি ঘুমিয়ে সময় কাটাতে রাজি ছিলেন না।
ক্যাটরিনা জানান, তাঁরা একসঙ্গে সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটাতে চেয়েছিলেন।
সেই সময় এক বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দেন, মায়ের সঙ্গে বিয়ের পোশাকের দোকানে যাওয়া উচিত।
ক্যাটরিনা তখনও বিবাহিতা নন, তবুও মায়ের সঙ্গে সেই বিশেষ মুহূর্ত কাটানোর জন্য তিনি রাজি হন।
পোশাকের দোকানে গিয়ে তাঁরা একসঙ্গে পোশাক দেখেন, মা তাঁর পছন্দের কথা জানান।
ক্যাটরিনা জানান, তিনি মায়ের পছন্দের পোশাকটিই পরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবেন।
মা চলে যাওয়ার পর, তাঁর অনুসারীরা এখন ক্যাটরিনাকে অনুসরণ করেন।
ক্যাটরিনা বলেন, মায়ের মতো তিনিও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
তিনি তাঁর মায়ের স্মৃতি নিয়ে ভিডিও তৈরি করেন, রান্নার ভিডিও বানান, যা তাঁর মায়ের খুব প্রিয় ছিল।
মায়ের হাতের সিনামন রোল তৈরির রেসিপি শেয়ার করেন, যা তৈরি করতে তাঁর মায়ের খুব ভালো লাগত।
ক্যাটরিনা বলেন, তিনি প্রতিদিন হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেন, আর তাঁর মায়ের অনুসারীরাও তাঁকে উৎসাহিত করেন।
তাঁরা বলেন, “তোমার মধ্যে তোমার মায়ের আলো ঝলমল করে, তুমিই তো তোমার মা, আর তিনি সবসময় তোমার সঙ্গেই আছেন।”
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলে ক্যাটরিনার কানে বাজে মায়ের বলা সেই কথা—‘গুড মর্নিং, সানশাইন’।
তথ্য সূত্র: পিপল