পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে ফিল্ড মার্শাল পদে পদোন্নতি: তাৎপর্য কী?
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সামরিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটি পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো সেনা কর্মকর্তাকে এই পদোন্নতি দেওয়া হলো। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদোন্নতি একদিকে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনই এর রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাবও সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
মে মাসের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত, তবে তীব্র সামরিক উত্তেজনা দেখা দেয়। উভয় দেশই একে অপরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে, যা কার্যত পঞ্চম যুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১০ই মে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। উভয় দেশই এই সংঘাতে নিজেদের জয় দাবি করে। পাকিস্তানের সরকার এই পদোন্নতির কারণ হিসেবে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত সাফল্যের বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জেনারেল মুনিরকে সেনাবাহিনীর প্রতি তাঁর ‘অসাধারণ সাহস ও দৃঢ় নেতৃত্বের’ স্বীকৃতিস্বরূপ ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ভারতের আক্রমণের বিরুদ্ধে কৌশল তৈরি করে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
ফিল্ড মার্শাল হলো সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য অনুসরণ করা দেশগুলোতে এই পদ সাধারণত বিরল। পাকিস্তানে সাধারণত, একজন জেনারেল-পদধারী (চার তারকা) কর্মকর্তা সেনাপ্রধান বা জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির (সিজেসিএসসি) চেয়ারম্যান হন। উল্লেখ্য, সিজেসিএসসি-এর প্রধান হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রধান, নৌবাহিনীর প্রধান এবং বিমান বাহিনীর প্রধানসহ তিন বাহিনীর প্রধানদের সমন্বয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে, পাকিস্তান ১৭ জন সেনা প্রধান পেয়েছে। আসিম মুনির দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হলেন। এর আগে, এই পদে উন্নীত হয়েছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং নিজেকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেন।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ফিল্ড মার্শাল পদটি মূলত একটি সম্মানজনক বিষয়। তবে, এর মাধ্যমে জেনারেল মুনিরের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তিনি ২০২৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তবে, সম্প্রতি একটি আইন পাস হওয়ায় তিনি আরও পাঁচ বছর এই পদে থাকতে পারবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসিম মুনিরের এই পদোন্নতি সরকারের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে সরকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে। এছাড়া, অনেকের মতে, এই পদোন্নতি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আরও সুসংহত করবে এবং দেশের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব আরও বাড়িয়ে তুলবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশটির স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা সরাসরি দেশ শাসন করেছে। অতীতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে। জেনারেল মুনিরের উত্তরসূরি জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াও সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা স্বীকার করেছিলেন।
অন্যদিকে, জেনারেল মুনিরের নেতৃত্বে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। ২০২৩ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৮ শতাংশের বেশি, যা বর্তমানে কমে ০.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ১০ বিলিয়নের সামান্য উপরে রয়েছে।
তবে, অনেকে মনে করেন, ফিল্ড মার্শাল পদে আসিম মুনিরের পদোন্নতি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য ভালো হবে না। তাঁদের মতে, এর ফলে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা আরও বাড়বে, যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা