নারীদের শরীরে দীর্ঘস্থায়ী স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত ব্যথায় প্রায়শই চিকিৎসকদের কাছ থেকে সঠিক মনোযোগ মেলে না, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের ব্যথায় আক্রান্ত নারীদের অভিযোগকে হালকাভাবে দেখা হয় অথবা মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
একে চিকিৎসা পরিভাষায় ‘মেডিকেল গ্যাসলাইটিং’ বলা হয়। এই সমস্যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও বিদ্যমান থাকতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিস এবং ভালভোডিনিয়া—এই দুটি হলো স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত এমন দুটি সমস্যা যা অনেক নারীর কাছে অসহনীয় শারীরিক কষ্টের কারণ। এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে জরায়ুর বাইরে টিস্যু বৃদ্ধি পায়, আর ভালভোডিনিয়া হলো যোনিপথে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার সমস্যা।
এইসব রোগাক্রান্ত রোগীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, এমনকি সামান্য নড়াচড়াও তাঁদের জন্য কষ্টকর হয়ে ওঠে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, উন্নত বিশ্বে প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে প্রায় ১ জনের এই সমস্যাগুলো রয়েছে। তবে, অনেক নারীই তাঁদের শারীরিক কষ্টের কথা জানালে চিকিৎসকদের কাছ থেকে তেমন সহানুভূতি পান না। অনেক সময় তাঁদের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, বরং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করা হয়।
চিকিৎসকদের এমন মানসিকতার কারণ হিসেবে চিকিৎসা গবেষণার দুর্বলতা এবং প্রশিক্ষণের অভাবকে দায়ী করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে, রোগীদের বলা হয়, “এসব তো তোমার মনের ভুল।
গবেষণায় দেখা গেছে, ভলভোভ্যাজাইনাল ব্যথায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশকে ডাক্তাররা বলেছেন, “আরও একটু বিশ্রাম নাও।” এমনকি ৩৯ শতাংশ রোগী এমনও অনুভব করেছেন যে, তাঁরা “পাগল” হয়ে যাচ্ছেন।
উদ্বেগের বিষয় হলো, এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৫৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেওয়ার আশা ছেড়ে দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অভিজ্ঞতা তাঁদের মধ্যে গভীর মানসিক প্রভাব ফেলে। শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি, তাঁরা একাকীত্বে ভুগতে শুরু করেন। অনেকেই নিজেদের কষ্টের অনুভূতি নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেন এবং একসময় নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও দ্বিধায় পড়ে যান।
এর ফলস্বরূপ, উদ্বেগ, হতাশা এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস-এর মতো মানসিক সমস্যাগুলো তাঁদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
চিকিৎসকদের এমন আচরণ নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর আস্থা কমাতে পারে। অনেক সময় রোগীরা ভয়ে ডাক্তার দেখাতে চান না, এই বুঝি তাঁদের কথা আবারও কেউ গুরুত্ব দেবে না।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীর প্রতি এই ধরনের অবহেলা বা বৈষম্যের মূল কারণ হলো, চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদ্যমান কিছু পুরনো ধ্যান-ধারণা। একসময় ধারণা করা হতো, মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যাগুলো মানসিক—শারীরিক নয়।
এই ধরনের ভুল ধারণা আজও অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণ এবং মানসিকতার পরিবর্তনে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। রোগীদের কথা মনোযোগ সহকারে শোনা এবং তাঁদের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
সেই সঙ্গে, সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং নারীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা জরুরি।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি এই ধরনের অবহেলা দূর করতে হলে, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ আরও উন্নত করতে হবে। সেই প্রশিক্ষণে নারী স্বাস্থ্য এবং বিভিন্ন স্ত্রীরোগ বিষয়ক সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিতে হবে।
বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পরিবার, সমাজ এবং স্বাস্থ্যখাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এই বিষয়ে আরও গবেষণা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য।
তথ্য সূত্র: সিএনএন