যুদ্ধকালীন চিঠি: যুদ্ধের বিভীষিকা আর মানবিক সম্পর্কের এক মর্মস্পর্শী দলিল
যুদ্ধ সবসময়ই মানুষের জীবনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। সৈনিকদের কাছে চিঠি কেবল একটি বার্তা নয়, বরং প্রিয়জনদের সঙ্গে তাদের সংযোগের এক সূক্ষ্ম সুতো।
শত শত বছর ধরে, সৈন্যরা তাদের অভিজ্ঞতা, ভয়, আর ভালোবাসার কথা লিখে এসেছেন চিঠিতে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত “বিহাইন্ড দ্য লাইনস” নামের একটি তথ্যচিত্র যুদ্ধের সেই সব চিঠিগুলোকেই কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে, যা যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং মানুষের ভেতরের সম্পর্কগুলোর এক অসাধারণ চিত্র তুলে ধরে।
এই তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে “সেন্টার ফর আমেরিকান ওয়ার লেটার্স”-এর সংগ্রহ থেকে, যেখানে যুদ্ধের নানান সময়ের চিঠিগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই চিঠিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিপ্লবী যুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং আরও সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধগুলোর অভিজ্ঞতা।
খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা জন বি. বেনিৎজ এই তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছেন, যেখানে কণ্ঠ দিয়েছেন অ্যানেট বেনিং, লরা ডার্ন, কমন, মাইকেল সি. হল-এর মতো তারকারা।
তথ্যচিত্রটিতে যুদ্ধের নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা দর্শকদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করবে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর পার্ল হারবার আক্রমণের একটি মর্মস্পর্শী বর্ণনা।
ইউএসএস নিউ অরলিন্স জাহাজের অভ্যন্তরে আটকা পড়া নাবিক উইলিয়াম জাকারো তাঁর বোনের কাছে লেখা চিঠিতে সেই দিনের ভয়াবহতা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “এখন সকাল ৯টা বেজে ৫ মিনিট, রবিবার। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আমাদের ওপর বোমা বর্ষণ চলছে… আমাদের বিমান-বিধ্বংসী কামানগুলো অবিরাম গর্জন করছে, আর মাঝে মাঝেই বোমা এত কাছে পড়ছে যে জাহাজটি কেঁপে উঠছে। আমরা ইঞ্জিনের সামনের অংশে অসহায়ভাবে আটকা পড়ে আছি।”
যুদ্ধ যে শুধু সৈনিকদের জীবন কেড়ে নেয় তা নয়, বরং প্রিয়জনদের থেকেও দূরে সরিয়ে দেয়। তথ্যচিত্রে এমন কিছু হৃদয়বিদারক ঘটনার উল্লেখ আছে, যা যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা আরও একবার প্রমাণ করে।
এর মধ্যে একটি ঘটনা হলো, ল্যান্স কর্পোরাল অ্যারন অস্টিনের, যিনি ২০০৪ সালের ২৬শে এপ্রিল ফালুজার যুদ্ধে নিহত হন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি তাঁর বাগদত্তা টিফানির কাছে একটি অডিও বার্তায় তাঁর ভালোবাসার কথা জানান এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন।
অ্যারনের মা, ডি’অন অস্টিন-মিলার, তাঁর ছেলের শেষ কথাগুলো স্মরণ করে বলেন, “আমার ছেলে, আমি তোমাকে সবসময় ভালোবাসব।”
যুদ্ধ সবসময়ই সম্পর্কের ওপর এক কঠিন চাপ সৃষ্টি করে। কখনো কখনো সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে মানুষ অন্য পথে পা বাড়ায়। গৃহযুদ্ধের সময়কার এক সৈনিকের ঘটনা এর প্রমাণ।
তিনি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি বৈবাহিক বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলে।
যুদ্ধ শুধু ধ্বংস আর বিভীষিকার জন্ম দেয় না, বরং এর মধ্যে মানবিক সম্পর্কগুলোও নতুনভাবে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জর্জ সাইতো নামের একজন জাপানি-আমেরিকান সৈন্য, তাঁর বাবাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বন্দীশিবিরে ছিলেন।
জর্জ তাঁর ভাইয়ের দেশের জন্য আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করে বাবাকে দুঃখ প্রকাশ না করে, দেশের প্রতি আস্থা রাখতে বলেছিলেন।
“বিহাইন্ড দ্য লাইনস” তথ্যচিত্রটি যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং এর মানবিক দিকগুলো তুলে ধরে। এটি যুদ্ধের ইতিহাসকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং যুদ্ধের স্মৃতিগুলোকে আরও গভীরভাবে অনুভব করতে সহায়তা করে।
তথ্য সূত্র: পিপল