দেশীয় প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থবিরোধী এবং ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। দেশের টাকায় সবকিছু করে এখন বিদেশিদের হাতে টার্মিনালটি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক। বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার টার্মিনালটি আরব-আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে সিদ্ধান্ত বাতিল না করে আওয়ামী লীগ সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে যা টার্মিনালে নিয়োজিত ৫ হাজার কর্মীর জীবিকা হুমকিতে ফেলবে।
নিউমুরিং টার্মিনালটি সুপার স্ট্রাকচার সমৃদ্ধ একটি আন্তর্জাতিকমানের টার্মিনাল এবং এটি সক্ষমতার চেয়ে বেশি সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে গত বছরেও।এটি চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যাতে এক সাথে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়তে পারে। আবার এর সাথে স্বয়ংক্রিয় ক্রেন থাকায় দ্রুতগতিতে কন্টেইনার ওঠানো ও নামানো যায়। গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন লাখ কন্টেইনার বেশি ওঠানামা হয়েছে এই টার্মিনালে।৭০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে এই টার্মিনাল করা হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি কিনে পরিচালিত হচ্ছে। আবার এটি সম্প্রসারণেরও সুযোগ নেই। ফলে এই টার্মিনালে আর নতুন করে বিনিয়োগের কোনো সুযোগ নেই।
মূলত কোনো বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আনা হয় দুটো কারণে। এর একটি হলো বিনিয়োগ পাওয়া, আর অন্যটি হলো দক্ষতা বৃদ্ধি। কিন্তু নিউমুরিং টার্মিনালে নতুন করে এসব খাতে বিনিয়োগের সুযোগ যেমন নেই, তেমনি- পাশেই নৌঘাঁটি থাকায় এটি সম্প্রসারণেরও সুযোগ নেই। অন্যদিকে বে টার্মিনাল ও লালদিয়ার চরে টার্মিনালের কাজ বিদেশিদের দেয়া নিয়ে কেউ আপত্তি করছে না। এর কারণ হলো সেখানে জেটি নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও সুপার স্ট্রাকচার আনার সুযোগ আছে। ফলে এখানে তারা কোথায় বিনিয়োগ করবে এবং বন্দরের দক্ষতা কতটা বাড়াবে সেটা সরকারের স্পষ্ট করা উচিত।একই কারণে পতেঙ্গার টার্মিনালের দায়িত্ব সৌদি প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও কোনো কথা ওঠেনি।
জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ২০০৬ সালে টার্মিনাল পরিচালনা করতে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। অথচ সেই ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতেই অন্তর্বর্তী সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার তুলে দিতে চাইছে। এসব পরিকল্পনা হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় করা হচ্ছে যা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা জন্য হুমকি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। দেশের আমদানি–রপ্তানির সিংহভাগ এর ওপর নির্ভরশীল। চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে দেশের নৌঘাঁটি, বিমানঘাঁটিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার অবস্থান। এমন একটি স্থানে বিদেশি কোম্পানিকে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া ভবিষ্যতে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।সরকারের এ ধরনের অযাচিত অযৌক্তিক অলাভজনক ব্যবসায়ী উদ্যোগ বাংলাদেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির পাইপলাইন বা হৃদপিণ্ড খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দরটির শীর্ষ রাজস্ব-উৎপাদক স্বাবলম্বী নিউ মুরিং টার্মিনাল এনসিটি বিদেশীদের হাতে হস্তান্তর করা জাতীয় অর্থনীতি পঙ্গু করার সামিল ।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও একটা জাতি রাষ্ট্র নিজেদের বন্দর যদি নিজেরা চালাতে না পারে, এটা আমাদের জন্য লজ্জার ও অপমানের। অদক্ষতার কথা বলে কোনো অজুহাতে চট্টগ্রাম বন্দরকে দুবাইয়ে ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে ইযারা দেওয়া রাষ্ট্রের অদূরদর্শীতার পরিচয় বহন করে।
ক্যাপ্টেন রেদওয়ান সিকদার
ষ্টেট কাউন্সিলর
সাউথ এশিয়ান স্ট্রাটেজিক কংগ্রেস।