যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও লেবাননের মানুষজন ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের দিকে তাকিয়ে, যেন তারা দর্শক—এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষগুলোর জন্য, যেখানে যুদ্ধ যেন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, সেখানে এই নতুন সংকট যেন অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে।
তারা একদিকে যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি এই ঘটনায় তাদের মধ্যে এক ধরনের নীরবতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দামেস্কের একটি পার্কে বসে ২৫ বছর বয়সী খালদুন হাল্লাক তার বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। সেখানে তারা ইয়েরবা মেট পান করতেন, বাদাম খেতেন, আর হুঁকো টানতে টানতে ক্ষেপণাস্ত্রের আকাশপথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
হাল্লাক বলেন, “আমরা ১৪ বছর ধরে যুদ্ধ দেখছি, কিন্তু এই প্রথম সিরিয়ার কিছু করার নেই, আমরা কেবল দর্শক।”
গত সপ্তাহে ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর হামলা চালায়, তখন এর জবাবে ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করে। এরপর থেকেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে।
সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আছড়ে পড়েছে, এতে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আগুন লেগেছে এবং সিরিয়ায় একজন নারী নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
তবে এখন পর্যন্ত দেশগুলো সরাসরি এই সংঘাতে জড়ায়নি।
লেবাননে, যেখানে গত বছর ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানকার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কিছু ভিডিও শেয়ার করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ক্ষেপণাস্ত্রের ঝলকানির মধ্যে তারা বাড়ির ছাদে নাচানাচি করছে এবং পানাহার করছে।
ইউরেশিয়া গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরাস মাকসাদ, যিনি এই সংঘাতের সময় লেবানন সফরে ছিলেন, একটি বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন।
তখন আকাশে ক্ষেপণাস্ত্রের সারি দেখা গেলে ডিজে ‘গিম্মি! গিম্মি! গিম্মি! (এ ম্যান আফটার মিডনাইট)’ গান বাজাচ্ছিলেন।
তিনি সেই দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়।
মাকসাদ বলেন, “লেবানন এবং সিরিয়ার বেশিরভাগ মানুষই এই পরিস্থিতি থেকে দূরে থাকতে পেরে খুশি।”
এই অঞ্চলের কারো কারো মধ্যে দুই পক্ষের এই লড়াই দেখে এক ধরনের আনন্দও দেখা যাচ্ছে। সিরীয় ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, যার অর্থ হলো, “শূকরের চামড়ার মধ্যে কুকুরের দাঁত।”
এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, দুটি ঘৃণ্য ব্যক্তি যখন লড়াই করে, তখন মানুষজন আনন্দ পায়।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত নিয়ে সিরীয়দের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে প্রায়ই এই প্রবাদটি শোনা যাচ্ছে।
দামেস্কের ১৮ বছর বয়সী আহমদ আল-হোসেন বন্ধুদের সঙ্গে পার্কে বসে সোমবার রাতের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ করুন, অত্যাচারীরা যেন একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
আমি চাই এটা চলুক।
আমরা উভয় পক্ষের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।”
খাল্লাকও একই সুরে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “যখনই আমরা একটি ক্ষেপণাস্ত্র উঠতে দেখি, তখনই বলি, আল্লাহ এই লড়াইয়ে আরও আগুন দিন।
যদি কোনো এক পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে আমরা খুশি হব, আর অন্য পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও খুশি হব।
তাদের মধ্যে যদি কোনো সমঝোতা হয়, তবেই আমরা দুঃখিত হব।”
লেবাননে গত বছরের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর যুদ্ধে চার হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল, যার মধ্যে কয়েকশ বেসামরিক নাগরিকও ছিল।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে এবং বৈরুতের কিছু অংশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়।
সেখানকার অনেকে এখন তেল আবিবের ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর ছবি দেখে প্রতিশোধের স্বাদ অনুভব করছে।
তবে এখনো হিজবুল্লাহ অনেকটা নীরব রয়েছে।
গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র-মধ্যস্থতায় হওয়া একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে সর্বশেষ ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল।
এরপর থেকে হিজবুল্লাহ অনেকটা শান্ত রয়েছে এবং ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত তারা দেয়নি।
লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সিডনের ৩৫ বছর বয়সী ওয়েল্ডার হুসেইন আল-ওয়ালিদ বলেন, “অবশ্যই আমি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে, আর ইরান একটি ইসলামিক দেশ, যা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।”
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ক্যারোলিন রোজ বলেন, “এটা স্পষ্ট যে, ইরানের সমর্থনপুষ্ট দলগুলো—বিশেষ করে হিজবুল্লাহর—এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণের ক্ষমতা নেই।”
তবে ইসরায়েল যদি ইরানের বাইরে তাদের অভিযান আরও বাড়ায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইরানের ‘সন্ত্রাসবাদের অক্ষ’ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন।
‘অক্ষ’ বলতে তিনি তেহরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে বুঝিয়েছেন, যা এই অঞ্চলে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ নামে পরিচিত।
রোজ বলেন, এই লক্ষ্যটি অস্পষ্ট, যা ইসরায়েলকে ইরান-সমর্থিত দলগুলোর আশ্রয়দাতা দেশগুলোতে যুদ্ধ প্রসারিত করার সুযোগ করে দিতে পারে, তা তারা যত দুর্বলই হোক না কেন।
লেবাননে নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে আল-ওয়ালিদ তেমন একটা চিন্তিত নন।
তিনি বলেন, “যুদ্ধ তো লেবাননে চলছেই।
ইসরায়েল চুক্তি মানছে না এবং প্রতিদিনই হামলা চালাচ্ছে।”
বৈরুতের পূর্বাঞ্চলে হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি রয়েছে।
সেখানের ২৬ বছর বয়সী ছাত্র হাসান শেরিফ বলেন, গত বছর লেবাননে যুদ্ধ এবং হিজবুল্লাহর ব্যাপক ক্ষতির পর অনেক সমর্থক হতাশ হয়ে পড়েছিল।
শেরিফ আরও বলেন, “সুতরাং, তেল আবিবে একটি জানালা ভাঙলেও তাদের কাছে এখন সেটা জয়।”
তিনি আরও জানান, যখনই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যায়, তখনই ওই এলাকার মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে।
তবে একই সঙ্গে, শেরিফ বলেন, “আরবিতে আমরা যেমন বলি, অনেকে দেয়ালের সঙ্গে মিশে থাকে, সতর্ক থাকে এবং প্রার্থনা করে যে আমরা যেন এর বাইরে থাকতে পারি।”
তথ্যসূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস