ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা: মধ্যপ্রাচ্যে ‘প্যান্ডোরা বক্স’ খোলার আশঙ্কা
যুক্তরাষ্ট্র কি ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইরানের ওপর সামরিক হামলা চালাতে পারে? এমন প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক মহলে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায়, যার মধ্যে মাটির গভীরে সুরক্ষিত ফোরদো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্টও রয়েছে, সেখানে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে কিছু আক্রমণ চালিয়েছে এবং তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে টার্গেট করেছে। এমতাবস্থায়, ইসরায়েলি নেতারা এখন অপেক্ষা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের এই কাজে সহায়তা করবেন কিনা।
বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে, ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানতে ক্রমশ আগ্রহী হচ্ছেন এবং সংকট সমাধানে কূটনৈতিক পথ থেকে সরে আসছেন।
হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, “আমি এটা করতেও পারি, নাও করতে পারি। তবে একটা কথা বলতে পারি, ইরানের অনেক সমস্যা আছে এবং তারা আলোচনা করতে চাইছে। আমি তাদের বলেছি, এত ধ্বংসযজ্ঞের আগে কেন আমার সঙ্গে আলোচনা করোনি?”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধের চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের দিকে মোড় নিতে পারে, যা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ পর্যন্ত চলতে পারে এবং ইসরায়েলের স্বার্থে আমেরিকান জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
ওয়াশিংটন ডিসির কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট, ত্রিতা পার্সি সিএনএনকে জানান, “যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ধরনের হামলা হলে, ইরানের পক্ষ থেকে ওই অঞ্চলে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোর উপর ব্যাপক হামলা হতে পারে এবং এর ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, তেহরান হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে না, তবে ওয়াশিংটনের জন্যেও কাজটি সহজ হবে না।
“ইরান একটি বিশাল দেশ, যার অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ইরানকে পাল্টা আঘাত হানার ক্ষমতা ধ্বংস করতে হলে অনেকগুলো স্থানে আঘাত হানতে হবে,” পার্সি যোগ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ট্রাম্পের নিজের শিবিরেও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করার বিষয়ে তেমন সমর্থন নেই।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র পলিসি ফেলো, এলি গেরানমায়াহ সিএনএনকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলা করে, তবে সেটি একটি ‘প্যান্ডোরা বক্স’ খুলে দেবে এবং সম্ভবত ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে।”
গেরানমায়াহ আরও বলেন, “একবার এই প্যান্ডোরা বক্স খুললে, এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আমাদের ধারণার বাইরে।”
ইরান ‘আত্মসমর্পণ করবে না’
ইতিমধ্যে ইরান মনে করে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের উপর চালানো হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের মদদ রয়েছে, কারণ ইসরায়েল আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করছে। ইরানের কিছু কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা একটি ‘পূর্ণাঙ্গ, দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।
বুধবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, ইরান কোনোভাবেই পিছু হটবে না। এর আগে ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় ‘শর্তহীন আত্মসমর্পণের’ কথা বলেছিলেন।
খামেনি বলেন, “আমেরিকানদের জেনে রাখা উচিত, ইরানের জনগণ আত্মসমর্পণ করার মতো নয় এবং তাদের কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে।”
যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি এই সংঘাতে জড়িয়ে পরে, তাহলে ইরান সম্ভবত ইরাক, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার তাদের অনুগত শক্তিগুলোকে সক্রিয় করবে। এই শক্তিগুলো অতীতেও ওই অঞ্চলে আমেরিকান স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জেতা ইরানের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তাই তারা দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের কৌশল নিতে পারে, যেখানে তারা তাদের প্রতিপক্ষের মনোবল এবং যুদ্ধ করার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। যেমনটা তারা ১৯৮০-র দশকে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের সঙ্গে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে করেছিল।
পার্সি বলেন, “ইরানের কৌশল হতে পারে নিজেদের টিকিয়ে রাখা, যতটা সম্ভব পাল্টা আঘাত হানা এবং ট্রাম্প হয়তো একসময় এই যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করবেন, যেমনটা তিনি ইয়েমেনে করেছিলেন।”
মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কয়েক মাস ধরে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে, যা ইসরায়েলের জন্য হতাশাজনক ছিল।
জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক আবদোলরাসুল দিভসালার এক্স-এ লিখেছেন, “ইরান কিভাবে এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জেতার সুযোগ দেখছে, তা হলো তাদের আক্রমণাত্মক ক্ষমতা ব্যবহার করে এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দুর্বল করে।”
দিভসালার আরও যোগ করেন, “এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ করা সবার জন্য একটি খারাপ এবং ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত হবে।”
পারমাণবিক কর্মসূচি শেষ হবে না
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পরমাণু আলোচক, বর্তমানে নিউ জার্সিতে বসবাসকারী হোসেইন মুসাভিয়ান, ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে ফার্সি ভাষায় একটি পোস্টে লেখেন, তিনি যেন ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ফোরদোতে হামলা করা হলে তা ফলপ্রসূ হবে না – কারণ ইরান সম্ভবত তাদের উন্নত সেন্ট্রিফিউজগুলো অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়েছে – এবং এর ফলে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে আরও বেশি ঝুঁকবে।
মুসাভিয়ান লেখেন, “একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে, আপনি শুধু ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী হবেন না, বরং এর ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, যার পরিণতি আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার চেয়েও অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হবে।”
পার্সি বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়ে গেলেও, দেশটির সরকার চাইলে বোমা তৈরি করতে বেশি সময় লাগবে না।
তিনি বলেন, “ইরান বোমা বানানোর প্রযুক্তি ও সক্ষমতা দুটোই রাখে। একটি হামলা কেবল তাদের এই কর্মসূচিকে পিছিয়ে দেবে, তবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেবে।”
ফোরদোকে ইসরায়েল তাদের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে। তবে এই গোপন স্থাপনার ভেতরে ঠিক কী আছে, তা স্পষ্ট নয়, এমনটাই জানান পার্সি।
তিনি আরও বলেন, “মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজটি নাতানজ (পারমাণবিক কেন্দ্রে) চলছিল। ফোরদোতে অন্যান্য গবেষণা চলত।” ইরানের কাছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ কোথায় আছে, সে সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছে, পাহাড়ের গভীরে লুকানো এই স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা কতটা সফল হবে, তাও এখনো স্পষ্ট নয়।
ফোরদোর প্রধান হলগুলো মাটির প্রায় ৮০ থেকে ৯০ মিটার নিচে অবস্থিত, যা ইসরায়েলের যেকোনো বিমান হামলার থেকে সুরক্ষিত।
ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ইয়েচিয়েল লেইটার বলেছেন, এই স্থাপনা ধ্বংস করার মতো অস্ত্র কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর কাছেই আছে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, আমেরিকার ‘বাঙ্কার-ব্লাস্টার’ বোমা – জিবিইউ-57/বি, যা ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ নামে পরিচিত – সেটিও এই কাজটি করতে পারবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়।
তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা?
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের লাগাতার বোমা হামলার কারণে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা কোনো পারমাণবিক কেন্দ্রে আঘাত হানলে ইরানের সীমান্ত ছাড়িয়ে অনেক দূরেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
ইরানের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর বুশেহরে অবস্থিত। তবে ইসরায়েল এখনো পর্যন্ত সেটিকে লক্ষ্য করেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোরদোতে বোমা হামলা করলে পারমাণবিক চুল্লিতে আঘাত হানার মতো তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর ঝুঁকি থাকবে না।
নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভের নিউক্লিয়ার ম্যাটেরিয়ালস সিকিউরিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট স্কট রকার বলেন, ফোরদোতে বড় ধরনের তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর ঝুঁকি নেই, “কারণ ওই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তাজা, যা আমরা শিল্পে বলে থাকি।”
তিনি আরও বলেন, “এটি কোনো চুল্লির মধ্যে ব্যবহার করা হয়নি, তাই বুশেহরে অবস্থিত, কার্যকরী পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বোমা হামলা করলে যেমনটা হতো, তেমনভাবে তেজস্ক্রিয়তা বিস্তারের সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা ওই এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর যেহেতু এটি মাটির নিচে, তাই এর কতটুকু নির্গত হবে, তা বলা কঠিন।”
ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিজের (এফডিডি) ইরান প্রোগ্রামের সিনিয়র ডিরেক্টর বেহনাম বেন তালেবলোর মতে, বোমা হামলার ফলে রাসায়নিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা একটি পারমাণবিক চুল্লিতে আঘাত হানার চেয়ে ভিন্ন ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তিনি বলেন, কিছু উদ্বেগের কারণ অবশ্যই থাকবে, তবে একটি সক্রিয় চুল্লিতে আঘাত হানার মতো ঝুঁকি এখানে নেই।
তথ্য সূত্র: সিএনএন