মহাকাশে বার্তা: ভয়েজার মিশনে পাঠানো সোনার রেকর্ড, ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর চিঠি।
১৯৭৭ সাল। আমেরিকার ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে নাসা (NASA) দুটি মহাকাশযান পাঠায়, ভয়েজার ১ ও ২। সৌরজগতের বাইরের অজানা জগৎ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা শুরু হয়।
এই মহাকাশযানগুলোর সঙ্গে ছিল এক বিশেষ বার্তা—সোনার প্রলেপ দেওয়া তামার তৈরি ডিস্ক, যা ‘গোল্ডেন রেকর্ড’ নামে পরিচিত। এই ডিস্কগুলো যেন এক একটি মহাজাগতিক ‘চিঠি’, যা ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর হাতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এলিয়ো’ (Elio) নামের একটি ডিজনির (Disney) ছবিতেও এই গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে একটি কল্পনাবাদী দৃশ্য দেখা যায়। যেখানে এলিয়ো নামক এক চরিত্রকে ভিনগ্রহের বাসিন্দারা পৃথিবীর নেতা হিসেবে ভুল করে।
গোল্ডেন রেকর্ড আসলে পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে অন্য কোনো উন্নত সংস্কৃতির কাছে নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরার এক প্রয়াস। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (California Institute of Technology) গ্রহ বিজ্ঞানী এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর (National Geographic) একজন উদীয়মান অনুসন্ধানী, বেথানি এলম্যান (Bethany Ehlmann), এই রেকর্ডগুলোকে “পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসার চিঠি” হিসেবে বর্ণনা করেন।
এই রেকর্ডগুলি একদিকে যেমন ভিনগ্রহের প্রাণীদের জন্য তৈরি, তেমনই এটি আমাদের এই নীল গ্রহের প্রতিও উৎসর্গীকৃত।
কিন্তু এই গোল্ডেন রেকর্ডগুলো এখন কোথায়? আর কত দিনই বা মহাকাশে টিকে থাকবে তারা? আসুন, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিই।
**মহাকাশে পাঠানো মানবতার গান**
ভয়েজার মিশনে (Voyager mission) করে পাঠানোর জন্য গান ও ছবি নির্বাচন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগানকে (Carl Sagan)। তাঁর নেতৃত্বে বিজ্ঞানী, শিল্পী এবং প্রকৌশলীদের একটি দল এই কাজটি করেন।
পৃথিবীর জীবনের একটি সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরার জন্য, তাঁরা প্রকৃতি ও দৈনন্দিন জীবনের নানা শব্দ যুক্ত করেন। এর মধ্যে ছিল পাখির ডাক, তিমি মাছের গান, শিশুদের হাসি, হৃদস্পন্দন, পায়ের শব্দ, এমনকি মস্তিষ্কের তরঙ্গও।
রেকর্ডে প্রায় ৯০ মিনিটের গান ছিল। যেখানে মোৎজার্ট, বাখ, বিটোফেন এবং স্ট্রাভিনস্কির মতো পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতজ্ঞদের সুর ছিল, সেই সাথে ছিল সেনেগালের লোকসংগীত, অস্ট্রেলীয় আদিবাসী গান এবং চাক বেরির (Chuck Berry) “জনি বি. গুড” (Johnny B. Goode)-এর মতো গান।
এই রেকর্ডে আধুনিক ও প্রাচীন ৫৪টি ভাষায় শুভেচ্ছা বার্তা ছিল, সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রার ১১৫টি ছবিও যুক্ত করা হয়েছিল।
এই রেকর্ডগুলির কভারে একটি মানচিত্র খোদাই করা হয়েছে, যা ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের পৃথিবীর অবস্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে হাইড্রোজেন পরমাণুর চিত্র এবং রেকর্ডটি বাজানোর নির্দেশনাও দেওয়া আছে।
প্রতিটি ডিস্ক একটি সোনার প্রলেপযুক্ত অ্যালুমিনিয়াম জ্যাকেটের মধ্যে রাখা হয়েছে, যার সঙ্গে ছিল প্লে করার জন্য একটি কার্টিজ ও একটি সূঁচ।
ভয়েজার প্রকল্পের প্রধান কার্ল সাগান লিখেছিলেন, “এই মহাকাশযানগুলি অন্য কোনো উন্নত ভিনগ্রহী সভ্যতার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরেই সম্ভবত রেকর্ডটি বাজানো হবে। তবে এই ‘বোতল’ (রেকর্ড) মহাকাশ ‘সমুদ্রে’ পাঠানোর মাধ্যমে এই গ্রহের মানুষের জীবনের আশা প্রকাশ করা হয়েছে।”
**ভয়েজারের মহাকাশ যাত্রা**
ভয়েজার মহাকাশযানগুলি ঘণ্টায় প্রায় ৩৫,০০০ মাইল বেগে সৌরজগতের দূরতম গ্রহগুলির পাশ দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। তারা বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনের বিস্তারিত ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল।
উল্লেখ্য, শুধুমাত্র ভয়েজার ২-ই ইউরেনাস ও নেপচুনের কাছ থেকে ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৮৯ সালেouter planets-এর (বহির্গ্ৰহ) অভিযান শেষ হওয়ার পর, এই দুটি মহাকাশযান সৌরজগতের বাইরে পাড়ি জমায়।
২০১২ ও ২০১৮ সালে যথাক্রমে ভয়েজার ১ ও ২ সৌরজগত ত্যাগ করে আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে প্রবেশ করে।
বর্তমানে পৃথিবী থেকে ১৫ বিলিয়নেরও বেশি মাইল দূরে, ভয়েজার ১ মহাকাশে মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে দূরবর্তী বস্তু। ভয়েজার ২ আছে ১৩ বিলিয়ন মাইল দূরে।
আন্তঃনাক্ষত্রিক পরিবেশে গ্যাস, ধুলো এবং বিকিরণের পরিমাণ অনেক বেশি। এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ভয়েজার মহাকাশযানে বিকিরণ প্রতিরোধী যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে তাদের পুরনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের উপর এই মহাজাগতিক কণাগুলোর প্রভাব এখনো উদ্বেগের কারণ।
উভয় ভয়েজার মহাকাশযান এখনো তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছে। যদিও অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রম করার কারণে সংকেত পৃথিবীতে পৌঁছাতে প্রায় ২০ ঘণ্টা সময় লাগে।
ভয়েজার মিশনের মেয়াদ প্রায় শেষ হতে চলেছে। কারণ, মহাকাশযান দুটির প্লুটোনিয়াম পাওয়ার সাপ্লাই ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। মিশনে যুক্ত বিজ্ঞানীরা যন্ত্রাংশ বন্ধ করে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছেন, যাতে তারা আরও কিছু দিন টিকে থাকতে পারে।
ভয়েজার মিশনের বর্তমান প্রজেক্ট ম্যানেজার সুজান “সুজি” ডড (Suzanne “Suzy” Dodd) বলেছেন, “মিশনটি প্রায় ৪৭ বছর অতিক্রম করেছে, এখন খুব সামান্য শক্তি অবশিষ্ট আছে। আমাদের লক্ষ্য হলো, মিশনটিকে ৫০ বছর পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা।”
তবে, মিশনের বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরেও গোল্ডেন রেকর্ডগুলি মহাকাশে ভেসে বেড়াবে, সম্ভবত কয়েক মিলিয়ন এমনকি বিলিয়ন বছর ধরে।
সুজি ডড আরও জানান, “আমরা যখন মহাকাশযানের সঙ্গে যোগাযোগ হারাব, তখনও এই রেকর্ডগুলো ভ্রমণ করতে থাকবে—যেন একটি টাইম ক্যাপসুল। এটি খুবই উৎসাহজনক যে, আমাদের পৃথিবীর একটি অংশ, মানবজাতির একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ, গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ভ্রমণ করছে, যা কোনো ভিনগ্রহী সত্তা খুঁজে পেতে পারে।”
তবে, ডড উল্লেখ করেছেন, এর সঙ্গে বিশাল দূরত্ব এবং সময়ের ব্যবধান জড়িত। ভয়েজার ১-এর অন্য একটি নক্ষত্রমণ্ডলের কাছাকাছি যেতে প্রায় ৪০,০০০ বছর সময় লাগবে, যখন এটি গ্লিস ৪৪৫ (Gliese 445) নক্ষত্রের ১.৬ আলোকবর্ষের মধ্যে দিয়ে যাবে।
একই সময়ে, ভয়েজার ২-এর রস ২৪৮ (Ross 248) নক্ষত্রের ১.৭ আলোকবর্ষের মধ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
**গোল্ডেন রেকর্ডের উত্তরাধিকার**
গোল্ডেন রেকর্ড মহাকাশে এক বিশাল প্রভাব ফেলেছে। এলম্যানের মতে, ভয়েজার মিশনের পরে পাঠানো প্রায় প্রতিটি মহাকাশযানেই পৃথিবী থেকে পাঠানো কিছু না কিছু বার্তা ছিল।
তিনি আরও বলেন, “কিছু লোক বিজ্ঞানকে ঠান্ডা এবং হিসাব-নিকাশের বিষয় হিসেবে দেখে, তবে এটি আসলে কৌতূহল এবং বিস্ময়ের বহিঃপ্রকাশ। এটি মহাবিশ্বে আপনার চিহ্ন রাখার ক্ষমতা।”
প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা আমাদের এই সাহসী দূত এখনও গভীর মহাকাশ ভ্রমণে অবিরাম ছুটে চলেছে।
এলম্যান বলেছেন, “কে জানে, কয়েক মিলিয়ন বছর পর ভয়েজার মহাকাশযানগুলো কোনো ভিনগ্রহীর জাদুঘরে প্রদর্শিত হতে পারে। এটা কল্পনা করাও দারুণ!”
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক