**লাইবেরিয়ার জন্ম: মুক্তি নাকি শোষণের বীজ?**
আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত লাইবেরিয়ার ইতিহাস এক জটিল আখ্যান। উনিশ শতকের শুরুতে, দাসপ্রথা থেকে মুক্তি পাওয়া এবং মুক্ত জীবন যাপন করা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য এটি নতুন আবাসভূমি হিসেবে গড়ে ওঠে। তবে এর পেছনে ছিল গভীর কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, যা অনেকের কাছে আজও বিতর্কের বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন দাসত্বের অবসান ঘটছিল, তখন শ্বেতাঙ্গ এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে একটি ধারণা জন্মায়। তারা চেয়েছিল, মুক্ত হওয়া কৃষ্ণাঙ্গদের হয় আমেরিকাতেই সংহত করতে হবে, না হয় তাদের অন্য কোথাও পুনর্বাসন করতে হবে। এই ধারণার ফলস্বরূপ, ১৮১৬ সালে ‘আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি’ (American Colonization Society – ACS) গঠিত হয়। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আমেরিকায় বসবাস করা মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকার লাইবেরিয়ায় পাঠানো।
এই প্রক্রিয়ার পেছনে বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। কেউ চেয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্য দূর করতে, আবার কারো মূল লক্ষ্য ছিল দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখা। তারা মনে করত, লাইবেরিয়াতে কৃষ্ণাঙ্গদের পাঠিয়ে দিলে, দক্ষিণাঞ্চলে দাসত্বের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহের সম্ভাবনা কমে যাবে।
আমেরিকা থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার এই প্রক্রিয়া সহজ ছিল না। ১৮২০ সালে, প্রথম কিছু কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানকে নিয়ে একটি জাহাজ যাত্রা শুরু করে। তারা প্রথমে শেরব্রো দ্বীপে (Sherbro Island) পৌঁছায়। কিন্তু সেখানকার প্রতিকূল পরিবেশের কারণে দ্রুতই তাদের অন্য স্থানে যেতে হয়।
পরবর্তীতে, উপকূলের কাছাকাছি একটি স্থান নির্বাচন করা হয়, যা ছিল কেপ মেসুর্যাডো (Cape Mesurado) এলাকা। এখানে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে জমি কেনার চুক্তি হয়। জানা যায়, সেই সময় স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে জমি আদায় করা হয়েছিল।
১৮২৪ সালে, কেপ মেসুর্যাডো অঞ্চলের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরটির নাম দেওয়া হয় মনরোভিয়া, যা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর প্রতি সম্মান জানিয়ে করা হয়। আর এই পুরো কলোনির নাম হয় লাইবেরিয়া। এরপর, দলে দলে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এখানে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।
১৮৪৭ সাল পর্যন্ত মনরোভিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ৪,০০০ জনে পৌঁছেছিল। ১৮৬৭ সাল নাগাদ, প্রায় ১৩,০০০ জন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান লাইবেরিয়ায় এসে বসবাস শুরু করে।
কিন্তু লাইবেরিয়ার অভ্যুদয় এত সহজ ছিল না। কলোনির শুরু থেকেই স্থানীয় আদিবাসী এবং আগত আমেরিকানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। আমেরিকানরা, যারা ‘আমেরিকান-লাইবেরিয়ান’ নামে পরিচিত ছিল, তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং জীবনযাত্রা ছিল স্থানীয়দের থেকে ভিন্ন।
আমেরিকান-লাইবেরিয়ানরা ইংরেজি বলত, খ্রিস্ট ধর্ম পালন করত এবং ইউরোপীয়দের মতো পোশাক পরত। অন্যদিকে, স্থানীয় আদিবাসীরা নিজেদের সংস্কৃতি ও জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিল। এর ফলে, লাইবেরিয়ার সমাজে একটি গভীর বিভাজন তৈরি হয়। আমেরিকান-লাইবেরিয়ানরা স্থানীয় আদিবাসীদের সস্তায় শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করত। এর ফলস্বরূপ, বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা পরবর্তীতে সহিংস রূপ নেয়।
১৮৪৭ সালে লাইবেরিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। হাইতির পর এটি ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গ প্রজাতন্ত্র। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলো দ্রুত লাইবেরিয়াকে স্বীকৃতি দিলেও, যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে বেশ কয়েক বছর সময় নেয়।
এর কারণ ছিল আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি। লাইবেরিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর, দেশটি নিজেদের একটি সংবিধান তৈরি করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল।
লাইবেরিয়ার জন্ম একদিকে যেমন মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক, তেমনি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শোষণের ইতিহাস। স্বাধীনতা লাভের পরও, এখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা আমেরিকান-লাইবেরিয়ানদের দ্বারা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। এই বিভেদ পরবর্তীতে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের কারণ হয়, যা লাইবেরিয়ার ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক