ওয়েলসের পাহাড়ি পথে অনুষ্ঠিত ১০০ কিলোমিটারের আলট্রা-ম্যারাথন দৌড়ে বিজয়ী হয়েছেন এক মা। বিশেষ এই জয় এসেছে সন্তান জন্ম দেওয়ার মাত্র ছয় মাস পরেই, যখন তিনি তাঁর শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন।
এই বিরল ঘটনা ঘটিয়ে বিশ্বজুড়ে নারীদের জন্য এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন স্টেফানি কেইস।
স্টেফানি পেশায় একজন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী। দৌড়বিদ হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে।
উত্তর ওয়েলসের এরি ন্যাশনাল পার্কে আয়োজিত ‘আলট্রা-ট্রেইল স্নোডোনিয়া’ ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
দৌড় শুরুর আগে থেকেই তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল, দৌড়টি সম্পন্ন করা এবং নিজের শিশুকন্যা পেপারকে সময় মতো বুকের দুধ খাওয়ানো।
দৌড়ের নিয়ম অনুযায়ী, তিনি বিশেষ অনুমতি নিয়ে অতিরিক্ত একটি স্থানে থেমে মেয়ের খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
সাধারণ দৌড়বিদদের থেকে অনেক পরে, তৃতীয় দল থেকে দৌড় শুরু করেছিলেন স্টেফানি।
কারণ, দৌড়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তাঁর হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল না। এমনকি, বিজয়ী হওয়ার কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।
কঠিন এই দৌড়ের শেষে যখন তিনি জানতে পারেন, নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম, তখন তাঁর কাছে বিষয়টি ছিল অপ্রত্যাশিত।
দৌড়ের সময় মোট তিনবার তিনি তাঁর শিশু কন্যাকে বুকের দুধ খাইয়েছিলেন। দৌড়ের মোট সময়ের সঙ্গে সেই বিরতিগুলোও যোগ করা হয়েছিল।
নিজের এই সাফল্যের বিষয়ে স্টেফানি বলেন, “আমি এমনটা আশা করিনি।
আমার কল্পনার বাইরে ছিল সবকিছু।”
মে মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া এই দৌড়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকেই তাঁর এই সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
তবে কিছু ক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে।
স্টেফানি কেইস মনে করেন, তাঁর এই জয় প্রমাণ করে, মা হওয়ার পর জীবন থেমে যায় না।
বরং, এটি একজন নারীর জীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন একটি মাত্রা।
তিনি আরও যোগ করেন, “মা হওয়ার অনুভূতি শারীরিক ও মানসিক—উভয় দিক থেকেই বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে।
দৌড় আমার কাছে সেই পরিচিত জগৎটাকে ধরে রাখার মতো, যা আমাকে মনে করিয়ে দেয়, অনেক কিছু বদলে গেলেও কিছু বিষয় আগের মতোই আছে।
নিজের পরিচয়ের কিছু অংশ এখনো আমার সঙ্গে রয়েছে।”
৪২ বছর বয়সী স্টেফানি প্রায় ১৮ বছর আগে প্রথম ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন।
এরপর তিনি উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকাজুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দৌড়েছেন।
সন্তান ধারণের চেষ্টা করার সময় কয়েকবার গর্ভপাতের শিকার হওয়ায় তিনি প্রায় তিন বছর খেলা থেকে দূরে ছিলেন।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, কন্যা সন্তানের জন্মের ছয় সপ্তাহ পর তিনি আবার দৌড় শুরু করেন।
তাঁর ভাষায়, “শারীরিকভাবে কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল।
মনে হচ্ছিল, আমার শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো বুঝি বাইরে বেরিয়ে আসবে।
একই সঙ্গে, আমি আবার আগের মতোই দৌড়বিদ হয়ে উঠেছিলাম।”
আলট্রা-ট্রেইল স্নোডোনিয়ায় তৃতীয় দল থেকে দৌড় শুরু করাটা তাঁর জন্য সৌভাগ্যের বিষয় ছিল।
কারণ, এতে তাঁর ওপর কোনো চাপ ছিল না।
যেহেতু তিনি অন্যদের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিলেন, তাই ভালো ফল করার কোনো প্রত্যাশাও ছিল না তাঁর।
দৌড়ের নিয়ম অনুযায়ী, ২০ ও ৮০ কিলোমিটারে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
তবে নিজের মেয়ের দুধের চাহিদার কথা ভেবে তিনি ৫০ কিলোমিটারের একটি স্থানে তাঁর সঙ্গীর সাহায্য চেয়েছিলেন।
স্টেফানির স্বামী জন শুধু তাঁর হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারতেন।
তিনি স্টেফানির জলের বোতল, খাবার কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতে পারতেন না।
স্টেফানিকে নিজের সবকিছু একা সামলাতে হয়েছে এবং একই সঙ্গে মেয়ের দেখাশোনা করতে হয়েছে।
আগে পেপার প্রশিক্ষণ সেশনের মাঝে দুধ খেলেও, এমন প্রতিযোগিতার মধ্যে এর আগে কখনও খাওয়ানো হয়নি।
এই জয়ে স্টেফানির প্রতি অনেকে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি।
কেউ বলেছেন, “শিশুর সঙ্গে কি তিনি সময় কাটান না?
তাঁর তো বাড়িতে থাকা উচিত ছিল।”
কেউ তাঁর বয়স এবং শারীরিক গঠন নিয়েও কটাক্ষ করেছেন।
এই বিষয়ে স্টেফানি বলেন, “কিছু মা তাঁদের সন্তানের ছবি ও আমার এই সাফল্যের গল্প দেখে মনে করছেন, নারীদের জন্য হয়তো এমন উচ্চ মানদণ্ড তৈরি করা হচ্ছে যা অর্জন করা কঠিন।”
অনেক মা তাঁদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে ক্লান্ত। একদিকে সন্তানের দেখাশোনা, অন্যদিকে কর্মজীবন, শরীরচর্চা এবং আলট্রা-ম্যারাথনে দৌড়ানো—সবকিছু একসঙ্গে সামলানো কঠিন।
স্টেফানি মনে করেন, প্রতিটি নারীর মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা আলাদা।
কারও জন্য হয়তো এটি ১০০ কিলোমিটার দৌড়ানো, আবার কারও জন্য একটি বইয়ের ক্লাব বা অন্য কিছু।
তাঁর মতে, নারীদের এই স্বাধীনতা দেওয়া উচিত, যাতে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো জীবন বেছে নিতে পারেন।
জুলাই মাসে স্টেফানির পরবর্তী গন্তব্য হলো— ‘হার্ডরক ১০০’।
এটি একটি ১৬০ কিলোমিটারের দৌড় প্রতিযোগিতা, যা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে অনুষ্ঠিত হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন