যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার বাণিজ্য আলোচনার সর্বশেষ চিত্রটি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বেইজিং এখন দর কষাকষির ক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছেছে। সম্প্রতি লন্ডনে হওয়া বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যদিও বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের উপর তাদের প্রভাব বিস্তারের কৌশল ভালোভাবেই রপ্ত করেছে।
এই চুক্তিতে যদিও পুরনো কিছু বিষয় পুনর্বহাল করা হয়েছে, তবে চীনের নীতিনির্ধারকদের আত্মবিশ্বাসের কারণ হলো, তারা এখন বুঝতে পারছে যুক্তরাষ্ট্রের উপর তাদের কতটা ‘লিভারেজ’ বা দর কষাকষির ক্ষমতা রয়েছে। হংকং সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লিউ দংশু’র মতে, চীন সম্ভবত তাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি দর কষাকষির ক্ষমতা অর্জন করেছে। বেইজিং সম্ভবত উপলব্ধি করেছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যতটা কঠোর হিসেবে পরিচিত, বাস্তবে তিনি ততটা নন।
যদিও ট্রাম্প এই চুক্তিকে আমেরিকার জন্য জয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন, চীনের সরকারি ভাষ্যে এর চেয়ে অনেক বেশি সংযম দেখা গেছে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিজিটিএন-এর একজন ভাষ্যকার একে দুই পক্ষের মধ্যে “সমান আলোচনা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এই চুক্তিতে বাণিজ্য সম্পর্ককে বিস্তৃতভাবে নতুন রূপ দেওয়ার পরিবর্তে, মে মাসে হওয়া একটি সমঝোতাকে পুনরায় বহাল করা হয়েছে। যদিও এখনো ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রয়োজন, তবে বৃহত্তর অর্থনৈতিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা কত দ্রুত হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এই চুক্তিতে চীনের পণ্যের উপর শুল্ক বহাল থাকছে, যা বেইজিং পরিবর্তন করতে চাইবে।
চীনের বাণিজ্য কৌশল এখন অনেকটাই তাদের বিরল মৃত্তিকা খনিজ পদার্থের (rare earth minerals) ওপর নির্ভরশীল। এই খনিজ পদার্থগুলো মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের জন্য অপরিহার্য। ট্রাম্প যখন চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক বৃদ্ধি করেন, তখন চীন এই খনিজগুলোর রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে ইলেক্ট্রনিকস, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও অটোমোবাইল শিল্পে সংকট তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল, চীনের এই পদক্ষেপের ফলে তারা প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। লন্ডনে হওয়া বৈঠকে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য বিরল মৃত্তিকা খনিজ সরবরাহ দ্রুত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এই খনিজগুলোর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করতে রাজি হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন কান্ট্রি ডিরেক্টর বার্ট হফম্যানের মতে, চীন এই ঘটনার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছে যে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিরল মৃত্তিকা খনিজ রপ্তানির অনুমোদন দিতে চীনের বিলম্বের কারণ ছিল নতুন রপ্তানি নীতির সঙ্গে দেশটির কর্মকর্তাদের পরিচিত হতে সময় লাগা। ভবিষ্যতে বেইজিং সম্ভবত সামরিক উদ্দেশ্যে এই পণ্য রপ্তানি করবে না। চীনের পক্ষ থেকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে অন্যান্য ‘ঘাতক অস্ত্র’ ব্যবহারেরও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য চীনা নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণকেও একটি বিশেষ দিক হিসেবে দেখছেন। “ট্রাম্প অলওয়েজ চিকেনস আউট” (TACO) বা “ট্রাম্প সবসময় আলোচনার টেবিলে পিছু হটেন” – এমন একটি শব্দবন্ধ চীনের অনলাইন আলোচনাতেও দেখা যায়। বেইজিং মনে করে, ট্রাম্পের এই স্বভাব চীনের জন্য সুবিধা বয়ে আনতে পারে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করেছেন এবং তাকে “খুব কঠিন এবং চুক্তি করা কঠিন ব্যক্তি” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখাটা সম্মানের বিষয়।
আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। ট্রাম্প যদিও চুক্তিকে চূড়ান্ত বলেছেন, তবে বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো অমীমাংসিত। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনের পণ্যের ওপর এখনো উচ্চ শুল্ক বহাল রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার বাণিজ্য যুদ্ধ বা বাণিজ্য উত্তেজনা আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, এবং হালকা প্রকৌশল খাতের ব্যবসায়ীরা, যারা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এই পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উচিত হবে এই দুই দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের বাণিজ্য নীতি তৈরি করা, যাতে করে কোনো দেশের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক তৈরি হলেও, বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন