মাথার আঘাত থেকে সেরেব্রাল পালসি: এক মায়ের অবিচল লড়াই।
একটি সন্তানের জন্ম, প্রতিটি মায়ের কাছেই এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। কিন্তু জন্মের পরেই যদি সন্তানের শরীরে বাসা বাঁধে কোনো কঠিন রোগ, তখন মায়ের জীবনে নেমে আসে গভীর অনিশ্চয়তা।
তেমনই এক কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করা এক মায়ের গল্প এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা লেক্সি কুকের (Lexi Cook) জীবনের গল্প শুরু হয়েছিল অন্যরকম। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই তার গর্ভকালীন সময়ে জটিলতা দেখা দেয়।
চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, ২৯ সপ্তাহের মাথায় জন্ম হয় তার ছেলে, বো-এর (Bo)। জন্মের পর বো-কে রাখা হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (NICU)।
সেখানে পরীক্ষার পর জানা যায়, বো-এর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। চিকিৎসকেরা প্রথমে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তাদের ধারণা ছিল, প্রসবকালীন চাপের কারণে এমনটা হতে পারে এবং এতে ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু মাস কয়েক পর, বো-এর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন লেক্সি। বো-কে ডাকলে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতো না, কোনো কিছুর দিকে তাকাতো না।
এমনকি, মায়ের মুখের দিকেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। বো-এর বয়স যখন চার মাস, তখন লেক্সি তাকে নিয়ে যান শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে।
ডাক্তার শুরুতে তাকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন। কিন্তু যখন কোনো উন্নতি হলো না, তখন অনেক চেষ্টার পর বো-এর এমআরআই (MRI) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেই পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, বো-এর মস্তিষ্কের পেছনে, দৃষ্টি নিয়ন্ত্রক অঞ্চলে (occipital lobe) মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এর কিছু দিন পরেই জানা যায়, বো সেরেব্রাল পালসি (Cerebral Palsy) বা সিপি (CP) নামক স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত।
এটি এমন একটি অবস্থা, যা শিশুদের শারীরিক মুভমেন্ট এবং পেশী সঞ্চালনে সমস্যা সৃষ্টি করে।
ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, বো হয়তো কোনো দিন হাঁটতে পারবে না, কথাও বলতে পারবে না। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতেও লেক্সি ভেঙে পড়েননি।
তিনি বো-কে ভালো করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা চলতে থাকে।
প্রথমে চিকিৎসকেরা তেমন কোনো আশা দেখাননি। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
একদিন, লেক্সি লক্ষ করেন, বো চামচ অনুসরণ করছে। এরপর ধীরে ধীরে সে তার দিকে তাকাতে শুরু করে।
অবশেষে, আড়াই বছর বয়সে বো প্রথমবার হামাগুড়ি দিতে শুরু করে। এরপর, সাড়ে তিন বছর বয়সে সে তার প্রথম পদক্ষেপ নেয়।
বো-এর এই পথচলার প্রতিটি মুহূর্ত লেক্সি টিকটকে (TikTok) শেয়ার করতেন, যা অন্যদেরও আশা জুগিয়েছে। তার এই ভিডিওগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
বো এখন সাত বছরের একটি শিশু এবং স্থানীয় একটি স্কুলে (school) যায়। সেখানে একজন সাহায্যকারী (aide) তার সব কাজে সহযোগিতা করে।
বর্তমানে বো-এর শারীরিক উন্নতির জন্য নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার পায়ের মাংসপেশীর দুর্বলতা কমানো হয়েছে।
লেক্সি বলেন, “আমি যদি এক বিলিয়ন ডলারও পেতাম, তবুও আমি বো-কে বদলাতে চাইতাম না। আমি তাকে ‘স্বাভাবিক’ করতে চাই না।
আমাদের এই পথটা সহজ ছিল না, অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, একজন মা হিসেবে সন্তানের জন্য ভালোবাসা, আশা এবং রাগ—সবকিছু একসঙ্গে অনুভব করা সম্ভব।
আজও, লেক্সি এবং তার পরিবার বো-কে নিয়ে পথ চলছেন। প্রতি বছর মার্চ মাসে সেরেব্রাল পালসি সচেতনতা মাস উপলক্ষে তারা বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন।
বো-এর এই লড়াই অন্যদেরও সাহস যোগায়।
তথ্য সূত্র: পিপল (People)