ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই, যিনি তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থেকে অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো দমন করেছেন, বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ইসরায়েল, যা তাঁর প্রধান শত্রু, ইরানের আকাশসীমায় কার্যত অবাধ প্রবেশাধিকার লাভ করেছে এবং দেশটির সামরিক নেতৃত্ব ও পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর মারাত্মক আঘাত হানছে।
এমনকি তাঁর জীবননাশের হুমকিও দিচ্ছে তারা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করেছেন যে খামেনেইয়ের ‘টিকে থাকা উচিত নয়’।
৮৬ বছর বয়সী এই নেতার সামনে এখন কঠিন পরিস্থিতি। হয় তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে পারেন, যার ফলে ইসরায়েলের বোমা হামলায় আরও বড় ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি হবে। অথবা, তিনি কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন, যা যুক্তরাষ্ট্রকে এই সংঘাত থেকে দূরে রাখবে।
সেক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকবে, ইরানের বহু বছরের নীতি হিসেবে বিবেচিত পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে তাকে সরে আসতে হতে পারে।
সম্প্রতি এক ভিডিও বার্তায় খামেনেই তেহরানের প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ইরানি জাতি আত্মসমর্পণ করবে না।’ একইসঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি হস্তক্ষেপ করে, তবে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।’
আলী খামেনেই সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
১৯৮৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর খামেনেইকে তাঁর পূর্বসূরি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর উত্তরসূরি হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বেশ বেগ পেতে হয়। খোমেনীর মতো তাঁর ধর্মীয় জ্ঞান বা বিপ্লবী চেতনা ছিল না।
তবে খামেনেই খোমেনীর চেয়ে তিনগুণ বেশি সময় ধরে শাসন করেছেন এবং সম্ভবত ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রকে আরও বেশি প্রভাবিত করেছেন।
তিনি শিয়া মুসলিম ধর্মগুরুদের শাসন ব্যবস্থা সুসংহত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি কট্টরপন্থীদের কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজের স্থান সুনিশ্চিত করেছেন। একই সময়ে, তিনি বিপ্লবী গার্ডকে ইরানের সামরিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত করেন।
গার্ড ইরানের সবচেয়ে এলিট সামরিক বাহিনী এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির তত্ত্বাবধান করে। এর আন্তর্জাতিক শাখা কুদস ফোর্স ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ তৈরি করেছে, যা ইয়েমেন থেকে লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে।
এই জোটের মাধ্যমে ইরান দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এছাড়াও, খামেনেই বিপ্লবী গার্ডকে ব্যবসার অবাধ স্বাধীনতা দেন, যা তাদের ইরানের অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছে।
বদলে বিপ্লবী গার্ড তাঁর অনুগত বাহিনীতে পরিণত হয়।
ক্ষমতায় আসার পর খামেনেই সংস্কারপন্থীদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। সংস্কারপন্থীরা নির্বাচিত কর্মকর্তাদের আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন, যা খামেনেইয়ের রক্ষণশীল সমর্থকরা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করতেন।
খামেনেই ধর্মীয় নেতাদের একত্রিত করে সংস্কারপন্থীদের প্রতিহত করেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা খর্ব করা হয় এবং সংস্কারপন্থী প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়।
সংস্কার আন্দোলনের ব্যর্থতার পর বিপ্লবী গার্ড ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা বিক্ষোভ দমন করে। ২০০৯ সালে নির্বাচনের ফল নিয়ে বিতর্কের জেরে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে প্রতিবাদ হয়।
২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর হিজাব বিতর্ককে কেন্দ্র করে আরও বিক্ষোভ দেখা দেয়।
বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় বহু মানুষ নিহত হয় এবং আরও অনেকে গ্রেপ্তার হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অনেকের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে।
এসব বিক্ষোভ ইরানের ধর্মীয় শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ করে এবং শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক দুর্দশার বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষকে সামনে নিয়ে আসে। পরিস্থিতি শান্ত করতে কর্তৃপক্ষ অনেক সময় সামাজিক বিধিনিষেধ শিথিল করতে বাধ্য হয়।
ক্ষমতায় আসার সময় ইরান ছিল ইরাকের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে দুর্বল ও আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন।
পরবর্তী তিন দশকে, খামেনেই ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত করেন। এর একটি বড় কারণ ছিল ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাদ্দাম হোসেনের পতন, যার ফলে ইরানপন্থী শিয়া রাজনীতিবিদ ও মিলিশিয়ারা ইরাকে ক্ষমতায় আসে।
ইরাক ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’র কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই অক্ষের মধ্যে ছিল বাশার আল-আসাদের সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা।
২০১৫ সাল পর্যন্ত এই জোট তার সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল, যা ইরানকে ইসরায়েলের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
তবে, গত দুই বছরে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ইসরায়েলের বড় ধরনের প্রতিশোধমূলক হামলা হয়। ইসরায়েল এখন ইরানের মিত্রদের ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়েছে।
হামাসকে দুর্বল করা হয়েছে, যদিও নির্মূল করা যায়নি।
একইভাবে, ইসরায়েল হিজবুল্লাহকেও কোণঠাসা করেছে। গত বছর লেবাননে কয়েক সপ্তাহের বোমা হামলা এবং বিস্ফোরকযুক্ত ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে হিজবুল্লাহকে তারা দুর্বল করে দিয়েছে। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের পতনও হিজবুল্লাহর জন্য বড় আঘাত ছিল।
বর্তমানে, দামেস্কে ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রতি বৈরী একটি সরকার ক্ষমতাসীন।
বর্তমানে ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস