ইউরোপের অভিবাসন সংকট: এক দশকের ক্ষত আর উদ্বাস্তু জীবনের গল্প
গত এক দশকে ইউরোপে অভিবাসন সংকট এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাব আজও গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান। ২০১৫ সালে যুদ্ধ ও দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে আসা দশ লক্ষেরও বেশি অভিবাসী ও শরণার্থীর ঢল নামে ইউরোপে।
এদের মধ্যে অধিকাংশই সমুদ্রপথে গ্রিসের লেসবস দ্বীপে এসে পৌঁছায়, যা তুরস্ক থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই ঘটনার দশ বছর পরেও, সেই সংকটের স্মৃতি আজও সেখানে, এবং এর ফলস্বরূপ পরিবর্তনগুলো অনুভূত হচ্ছে সারা বিশ্বে।
লেসবস দ্বীপে আসা শরণার্থীদের মধ্যে ছিলেন ইরানের আমেনা নামজোয়ান, যিনি স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে জীবন বাঁচাতে এসেছিলেন। শুরুতে উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় তাদের।
আমেনা গ্রিক ভাষা শিখেছিলেন, কিন্তু সেখানকার প্রতিকূল পরিবেশে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। জার্মানির নতুন জীবনেও শান্তি খুঁজে না পেয়ে তিনি আবার লেসবসে ফিরে আসেন।
বর্তমানে তিনি একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন, যেখানে স্থানীয়রা তার রান্নার প্রশংসা করে, যদিও তারা অনেক সময় খাবারের নামগুলো ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। আমেনা বলেন, “গ্রিস আমার সংস্কৃতির কাছাকাছি, এখানে ভালো লাগে। আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত।”
তবে শরণার্থীদের এই আশ্রয় দেওয়ার মানসিকতা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে গ্রিসে অভিবাসন নীতি কঠোর হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকারের পরিপন্থী বলে মনে করা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেও অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় এসেছে পরিবর্তন। অভিবাসন এখন রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আগে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
২০১৫ সালের সেই সংকটকালে, লেসবসের এলপিনিকি লাউমি নামের এক নারীর কথা আজও মানুষের মনে আছে। তিনি তার সমুদ্রতীরবর্তী একটি রেস্টুরেন্টে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের খাবার ও পানি দিতেন।
তাদের আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন তিনি। সেই সময়ে একদিকে যেমন মানবিক সংকট দেখা গিয়েছিল, তেমনি এটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সমস্যারও জন্ম দেয়। গ্রিস তখন অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত ছিল, যা এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়।
শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। অনেক দেশ অভিবাসীদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
সীমান্ত বন্ধ করার পক্ষে জোরালো আওয়াজ ওঠে। এর ফলস্বরূপ, অবৈধ অভিবাসন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (International Organization for Migration) এর তথ্য অনুযায়ী, গ্রিসে অবৈধ অভিবাসন আগের তুলনায় অনেক কমেছে।
চোরাকারবারিরাও এখন নজরদারির কারণে পথ পরিবর্তন করেছে, যা তাদের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা ফ্রনটেক্স (Frontex) এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ইউরোপীয় সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রায় ৪০% কমেছে।
এই পরিস্থিতিতেও, অনেক রাজনীতিবিদ অভিবাসনকে একটি উদ্বেগের বিষয় হিসেবে তুলে ধরছেন। সম্প্রতি, অভিবাসন নীতি নিয়ে বিতর্কের জেরে নেদারল্যান্ডসের সরকার পর্যন্ত ভেঙে গেছে।
গ্রিসে নতুন অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী আশ্রয়প্রত্যাশীদের জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন।
বর্তমানে ইউরোপের দেশগুলো সীমান্ত নিরাপত্তা ও নজরদারির ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ইউরোপীয় কমিশন শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন কেন্দ্র (deportation centers) তৈরির অনুমতি দিয়েছে।
ইতালি, আলবেনিয়ায় তাদের কেন্দ্রগুলোতে শরণার্থীদের পাঠাচ্ছে, যদিও এর বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন দেশ পুনরায় দেয়াল তৈরি ও নজরদারি ব্যবস্থা জোরদার করছে, যা শীতল যুদ্ধের সময় দেখা গিয়েছিল।
ফ্রনটেক্স এখন ইউরোপের বৃহত্তম সংস্থায় পরিণত হয়েছে, যার বাজেট ১ বিলিয়ন ইউরোর বেশি (প্রায় ১১,৮০০ কোটি টাকার বেশি)।
লেসবস দ্বীপের মানুষেরা ২০১৫ সালের সংকটকে মিশ্র অনুভূতি নিয়ে স্মরণ করে। সেখানকার জেলে স্ট্র্যাটোস ভ্যালামিওস কিছু শিশুকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকের মরদেহ তার চোখের সামনেই সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায়।
তিনি আজও বলেন, “দশ বছর পরেও কিছুই বদলায়নি। আমি আজও ক্ষুব্ধ, কারণ এমন ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটতে পারে, যেখানে শিশুরা পর্যন্ত মারা যায়।”
লেসবসে আসা শরণার্থীরা তাদের যাত্রা পথে যেসব জিনিস ব্যবহার করতেন, যেমন— ছোট জুতো, ফলের রসের খালি প্যাকেট— সেগুলো এখনও সমুদ্রের তীরে পাওয়া যায়। এখানকার একটি শরণার্থী শিবিরে শিশুদের আঁকা ছবিগুলোও সেই সময়ের স্মৃতি বহন করে।
লেসবসের প্রায় ৮০,০০০ বাসিন্দা ২০১৫ সালের সংকটকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। এখানকার ইফি ল্যাটসৌদি নামের একজন নারী, শরণার্থীদের গ্রিক ভাষা শিখতে এবং কাজ খুঁজে পেতে সাহায্য করেন।
তিনি আশা করেন, লেসবসের ঐতিহ্য— অর্থাৎ, আশ্রয়প্রার্থীদের সাহায্য করার সংস্কৃতি— জাতীয় নীতির ঊর্ধ্বে টিকে থাকবে। তিনি বলেন, “পরিস্থিতি শরণার্থীদের জন্য এখানে একীভূত হওয়াটা কঠিন করে তুলেছে।
আমাদের কিছু একটা করতে হবে। আমি এখনও আশা করি।”
তথ্য সূত্র: