যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে কি সত্যিই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে? এমন একটি প্রশ্ন এখন অনেকের মনে। যদিও শুরুতে অনেক অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করেছিলেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে, কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি।
বরং, এখন পর্যন্ত বাজারে জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যবৃদ্ধি ছিল বার্ষিক ২.৪ শতাংশ। যা অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসের চেয়ে কম।
এমনকি, এপ্রিল মাসের ২.৩ শতাংশের তুলনায় সামান্য বেশি, যা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল।
ফেডারেল রিজার্ভের হিসাব অনুযায়ী, খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বাদে, মূল মুদ্রাস্ফীতি এপ্রিল মাসে কমে ২.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা ২০২১ সালের মার্চের পর সর্বনিম্ন।
অর্থনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের ধারণা থেকে এই চিত্রটা বেশ ভিন্ন। যদিও বিভিন্ন ব্যবসার মালিকরা জানিয়েছিলেন, শুল্কের কারণে তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হতে পারে।
কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয়নি।
ফিস রেটিং-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর শুল্কের হার ১৪.১ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ২.৩ শতাংশ।
অর্থাৎ, ট্রাম্প সরকার ২০২৫ সালে আমদানি পণ্যের ওপর প্রায় ১২ শতাংশ হারে কর বৃদ্ধি করেছেন।
এর ফলে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
গোল্ডম্যান স্যাকস-এর অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, চলতি বছর মূল মুদ্রাস্ফীতি ৬.৩ শতাংশ এবং ২০২৬ সালের শুরুতে ভোক্তা মূল্যবৃদ্ধি ৩.৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে দেখা গেছে, মে মাসে ভোক্তারা ধারণা করেছিলেন, চলতি বছর পণ্যের দাম ৬.৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
যদিও জুন মাসে এই পূর্বাভাস কমেছে, তবুও ভোক্তারা মনে করেন, ২০২৫ সালে মূল্যস্ফীতি ৫.১ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
তাহলে কি অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস ভুল ছিল? সম্ভবত না।
কারণ, আমেরিকার অর্থনীতি বিশাল এবং জটিল। দাম কখন বাড়বে বা কমবে, তা অনুমান করা খুবই কঠিন।
বিশেষ করে ট্রাম্পের শুল্ক নীতির পরিবর্তনশীলতার কারণে এই কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরোম পাওয়েল জানিয়েছেন, শুল্কের কারণে কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে, যেমন চীন থেকে আসা ইলেকট্রনিক পণ্য।
কম্পিউটার ও অডিও-ভিডিও সরঞ্জামের দাম বেড়েছে।
তবে দাম বৃদ্ধি এখনো ব্যাপক নয়, কারণ ব্যবসায়ীরা তাদের আগের মজুত বিক্রি করছেন।
টিলসি অ্যাডভাইজরি গ্রুপের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে নির্বাচিত ৮০টি পণ্যের মধ্যে মাত্র ১৯টির দাম বেড়েছে, আর ১৬টির দাম কমেছে।
এমনকি, যেসব গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, সেগুলোর দামও বাড়েনি। বরং কমেছে।
এপ্রিল মাসে নতুন গাড়ির দাম ০.২ শতাংশ কমেছে।
যদিও অনেক ডিলার তাদের আগের কম দামের গাড়ি বিক্রি করছেন, তাই দাম এখনো সেভাবে বাড়েনি।
দাম স্থিতিশীল থাকায় ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে তাদের সাফল্য হিসেবে দেখছে।
হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমরা মন্দা বা মুদ্রাস্ফীতি পাইনি, বরং স্থিতিশীল মূল্য, শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছি।”
তবে, ট্রাম্পের এই সাফল্যের পেছনে কিছু বিষয় রয়েছে।
প্রথমত, তিনি তার বর্তমান মেয়াদে প্রায় ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বা তার বেশি শুল্ক আরোপ করেছেন।
যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানি পণ্যের ৭১ শতাংশ।
তার আগের মেয়াদে তিনি মাত্র ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল, যার ফলে মূল্যবৃদ্ধির সঠিক চিত্র পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল।
কিছু তথ্য বলছে, ট্রাম্পের শুল্কের কারণে কিছু খাতে দাম বেড়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালে ইস্পাতের ওপর শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন সামান্য বেড়েছে, কিন্তু গাড়ি, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের দাম বেড়ে যায় এবং ২০২১ সালে সেই শিল্পের উৎপাদন ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে যায়।
তবে, ট্রেজারি বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা জোসেফ লাভোর্গনা মনে করেন, শুল্কের কারণে এখনো পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির তেমন প্রভাব পড়েনি।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিটও একই কথা বলেছেন।
অন্যদিকে, অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আসন্ন গ্রীষ্মে হয়তো জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে।
কারণ, ব্যবসায়ীরা তাদের আগের মজুত বিক্রি করে ফেললে নতুন করে দাম বাড়াতে বাধ্য হবেন।
ওয়ালমার্ট, টার্গেট, লুলু লেমন, হোম ডিপো এবং কোস্টকো-এর মতো বড় কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, শুল্কের কারণে তাদের কিছু পণ্যের দাম বাড়াতে হতে পারে।
তবে তারা চেষ্টা করছে, যাতে দাম সহনীয় রাখা যায়।
ছোট ব্যবসায়ীরা বড় কোম্পানিগুলোর মতো সুবিধা পায় না।
ফলে তাদের জন্য শুল্কের কারণে দাম কমানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
টিলসি-র মতে, দাম বাড়লে তা সব পণ্যের ক্ষেত্রে সমানভাবে বাড়বে না।
সম্ভবত, গ্রীষ্মের শেষ দিকে বা সেপ্টেম্বরে কিছু পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করবে।
ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান পাওয়েলও এই বিষয়ে একমত হয়েছেন।
তিনি মনে করেন, গ্রীষ্মকালে ভোক্তাদের ওপর শুল্কের প্রভাব আরও বেশি দেখা যেতে পারে।
আমেরিকার অর্থনীতির এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য কিছু শিক্ষা দিতে পারে।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
তাই, বিভিন্ন দেশের শুল্ক নীতি আমাদের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদেরও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন