মারথা’স ভিনইয়ার্ড: ‘জস’-এর ৫০ বছর, আর বদলে যাওয়া এক দ্বীপ।
হলিউডের সিনেমা ‘জস’ (Jaws), যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে, শুধু সিনেমার ইতিহাসেই আলোড়ন তোলেনি, বরং একটি দ্বীপের জীবনযাত্রাকেও পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের মারথা’স ভিনইয়ার্ড দ্বীপ, যেখানে ছবিটির শুটিং হয়েছিল, সেই দ্বীপের মানুষের জীবন, অর্থনীতি, এমনকি তাদের সংস্কৃতিতেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
একটা সময় পর্যন্ত শান্ত, নিস্তব্ধ এই দ্বীপটি ‘জস’-এর হাত ধরে রাতারাতি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে, যা আগে হয়তো অনেকের কাছেই অজানা ছিল।
এক সময়ের নীরব, নিভৃত দ্বীপটি কিভাবে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এত পরিচিত হলো, সেই গল্পটা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ছবিটির শুটিংয়ের দিনগুলোতে। স্থানীয়রা বলছেন, ‘জস’ মুক্তি পাওয়ার আগে মারথা’স ভিনইয়ার্ড ছিল অনেকটা হলিউডের আলো ঝলমলে দুনিয়ার বাইরে।
ছবিটির শুটিং শুরু হওয়ার পরেই যেন সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে। দ্বীপের লাইব্রেরিয়ান বা গ্রন্থাগারিক বাও ভ্যান রিপার জানান, ‘জস আমাদের পরিচিতি এনে দিয়েছে। এর ফলেই সারা বিশ্ব থেকে মানুষজন এখানে আসতে শুরু করে।
এখন তো গ্রীষ্মকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে, এমনকি বিদেশ থেকেও অনেকে আসে “অ্যামিটি” (Amity) দেখতে।’ ছবিটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে, যারা এই সিনেমার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিভাবে ‘জস’ মারথা’স ভিনইয়ার্ডের জীবনকে নতুন রূপ দিয়েছে।
স্থানীয় জেলে থেকে শুরু করে অভিনেতা, এমনকি যারা ছবিতে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন, তাদেরও রয়েছে নানা স্মৃতি।
ছবিতে ডেপুটি হেন্ড্রিকসের চরিত্রে অভিনয় করা জেফরি ক্রেমার জানান, তার পরিবারের এখানে আসার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তিনি বলেন, ‘জস যখন এখানে আসে, তখন এটা ছিল বিশাল ব্যাপার, তবে মানুষজন ঠিক বুঝতে পারছিল না কী হতে চলেছে।
এই সিনেমার কাস্টিং ডিরেক্টর ছিলেন শারি রোডস। তিনি এখানকার অনেক স্থানীয় মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, যারা সবাই ছিলেন খুবই আন্তরিক। এর ফলে সিনেমার কাজটা আরও ভালো হয়েছিল।
শ্যুটিংয়ের সময় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এমনকি, জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে অ্যানিমেট্রনিক হাঙর ‘ব্রুস’-এর (Bruce) কার্যকারিতা নিয়েও সমস্যা ছিল। তবে পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ হাল ছাড়েননি।
জেফরি ক্রেমার আরও বলেন, ‘শুটিং প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হয়। সিনেমাটি নির্মাণের ধরনটাই যেন বদলে গিয়েছিল। ‘জস’ হলিউডের সিনেমার জগৎকে নতুন পথে চালিত করেছে।
হারবার ভিউ হোটেলের বিপণন পরিচালক জীন ওং জানান, একবার সিনেমার ক্রু’দের মধ্যে মারামারি হয়েছিল, যা এখন হোটেলের লোককথার অংশ। আবহাওয়া, হাঙরের সমস্যা এবং দীর্ঘ কাজের চাপের কারণে সবাই খুব ক্লান্ত ছিল, তাই এমনটা ঘটেছিল।
মারথা’স ভিনইয়ার্ড মিউজিয়ামের গবেষণা গ্রন্থাগারিক বাও ভ্যান রিপার বলেন, ‘আমি যখন সমুদ্র সৈকতে ছবি তোলার দৃশ্য দেখছিলাম, তখন সহকারী পরিচালক ১০০ জন সাহসী লোক চেয়েছিলেন, যারা পানিতে নেমে দর্শকদের মতো অভিনয় করবে।
আমি আর আমার বন্ধু সেই দলে ছিলাম। পানি ছিল বেশ ঠান্ডা, আর আমাদের কোমর পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পরে বুঝলাম, কেন তিনি এত সাহসী লোক চেয়েছিলেন!’
সিনেমাটি মারথা’স ভিনইয়ার্ডের অর্থনীতিতেও বিশাল পরিবর্তন এনেছে। স্থানীয় চার্লি ব্লেয়ার জানান, সিনেমা তৈরির সঙ্গে জড়িত টিমস্টাররা (Teamsters) পানির কাছাকাছি কাজ করতে পারছিল না।
তিনি তখন ছোট নৌকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পান। তিনি বলেন, ‘ইউনিভার্সালের (Universal) হয়ে আমি দিনে ২০-২২ ঘণ্টা কাজ করতাম। তারা পানি সম্পর্কে কিছুই জানত না।
কারেন্ট বা জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। প্রতিদিন কেউ না কেউ একটা নৌকা ডুবিয়ে দিত।’ সিনেমাটিতে “অ্যালেক্স কুইন্ট”-এর চরিত্রে অভিনয় করা জেফরি ভুরহিস জানান, ‘আমি যখন “হুইয়ার্ফ পাব” (Wharf Pub) চালাতাম, তখন অনেকে আমাকে এড়িয়ে চলত, কারণ আমি ছবিতে অভিনয় করেছি।
কিন্তু পরে যখন আমি অটোগ্রাফ দেওয়া শুরু করি, তখন অনেক ভক্তের দেখা পেতাম।’ মারথা’স ভিনইয়ার্ড চেম্বার অফ কমার্সের নির্বাহী পরিচালক এরিকা অ্যাশটন বলেন, ‘জস এবং মারথা’স ভিনইয়ার্ড একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
সিনেমাটি শুধু সমুদ্রের সাসপেন্সই দেখায়নি, বরং এই জায়গার আত্মা, এর সমুদ্রবন্দর, মানুষ এবং চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছে। মারথা’স ভিনইয়ার্ড শুধু সিনেমার শুটিংয়ের স্থান ছিল না, বরং আমরাও এর নির্মাণে সাহায্য করেছি এবং এটি আমাদেরও গড়ে তুলেছে।
এমনকি, এই সিনেমার কারণে এখানকার মানুষ হাঙর সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে।’ ‘জস’-এর হাত ধরে মারথা’স ভিনইয়ার্ডের এই পরিবর্তন আমাদের অনেক কিছুই শেখায়।
সিনেমার প্রভাব যে একটি জায়গার সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনে কতটা গভীর হতে পারে, মারথা’স ভিনইয়ার্ড তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কোনো স্থানের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর ফলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক