শিরোনাম: হৃদরোগ কমাতে স্ট্যাটিন: গুজব ও বাস্তবতার বিশ্লেষণ
বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগ একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে চিকিৎসকরা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ হল স্ট্যাটিন।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই এই ওষুধটি নিয়ে ভুল ধারণা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করা হয়। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি (ইনফ্লুয়েন্সার) স্ট্যাটিনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা ধরনের কথা বলেন।
তাদের মতে, স্ট্যাটিন সেবনের চেয়ে এর ক্ষতির পরিমাণ বেশি। এমনকি কেউ কেউ এমনও দাবি করেন যে, কোলেস্টেরলের ধারণাটাই নাকি একটি “মিথ্যা”, যা মূলত স্ট্যাটিন বিক্রি করার একটি কৌশল।
চিকিৎসকদের মতে, স্ট্যাটিন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে একটি অপরিহার্য ওষুধ। এটি শরীরে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং হৃদরোগের সম্ভাবনা হ্রাস করে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্থূলতা বিষয়ক চিকিৎসক ড. স্পেন্সার নাডলস্কি-র মতে, “সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটিন নিয়ে অনেক বেশি ভয় তৈরি করা হয়, অথচ এটি আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ওষুধ।” সারা বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ হৃদরোগের চিকিৎসায় স্ট্যাটিন ব্যবহার করেন।
কিন্তু কিভাবে এই সাধারণ ওষুধটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলো?
এর একটি কারণ হলো, কিটো ও কার্বোহাইড্রেট-মুক্ত খাদ্যের প্রচারকারীরা। এই ধরনের খাদ্যাভ্যাসে চর্বি জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণ করা হয় এবং শর্করা কম থাকে।
এর ফলে ওজন কমানো এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়া যেতে পারে বলে তারা দাবি করেন। এইসব খাদ্যের সমর্থকরা তাদের সাফল্যের প্রমাণ হিসেবে প্রায়ই বিভিন্ন মাংস ও চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়ার ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন।
কেউ কেউ আবার নিরামিষ থেকে মাংস-নির্ভর খাদ্যে পরিবর্তন হয়ে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার দাবি করেন। তবে, এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস শরীরে এলডিএল (LDL) কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
এলডিএল কোলেস্টেরলকে “খারাপ” কোলেস্টেরল হিসেবেও ধরা হয়, যা হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের দাবিকে “অর্থহীন” বলে মনে করেন। তাদের মতে, হৃদরোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
তাই লক্ষণ দেখা যাওয়ার আগেই অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এলডিএল কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রা হৃদরোগের প্রধান কারণ।
চিকিৎসকদের মতে, এলডিএল কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে (deciliter) ১০০ মিলিগ্রাম বা তার নিচে রাখা উচিত। এই মাত্রা অতিক্রম করলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
স্ট্যাটিন গ্রহণ করে রক্তে এই খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমানো যায়, যা হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
স্ট্যাটিন মূলত লিভারে উৎপাদিত কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং বর্তমানে এটি সারা বিশ্বে হৃদরোগের প্রধান চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
যদিও স্ট্যাটিনের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন মাংসপেশিতে ব্যথা, মাথাব্যথা ও হজমের সমস্যা, তবে এর উপকারিতা অনেক বেশি।
কিছু মানুষ স্ট্যাটিন গ্রহণে অভ্যস্ত হতে পারেন না। এর কারণ হতে পারে ওষুধটির কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অথবা ওষুধের প্রতি সংবেদনশীলতা।
তবে, চিকিৎসকরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এই সমস্যাগুলো সমাধানে সাহায্য করতে পারেন।
সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ট্যাটিন নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ায় অনেক রোগী ওষুধটি গ্রহণ করতে চান না। তাদের মধ্যে অনেকে মনে করেন, ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্যের কারণে স্ট্যাটিন তাদের জন্য ক্ষতিকর।
চিকিৎসকরা তাদের এই ধারণা ভাঙার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবে যাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আসে না, তাদের জন্য স্ট্যাটিন একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা।
বর্তমানে হৃদরোগের চিকিৎসায় আরও কিছু নতুন ওষুধ পাওয়া যায়, যেমন পিসিএসকে৯ ইনহিবিটরস (PCSK9 inhibitors)। এগুলো এলডিএল কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
তবে স্ট্যাটিনের মতো এগুলো নিয়ে তেমন বিতর্ক হয় না।
ডা. কোপেকির মতে, এলডিএল শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়, কারণ এটি কোষ গঠন এবং মেরামতের কাজে সহায়তা করে। তাই এর একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকা প্রয়োজন।
অতিরিক্ত এলডিএল-এর কারণে হৃদরোগ হতে পারে।
কোলেস্টেরল এবং স্ট্যাটিন নিয়ে অনলাইনে উপলব্ধ তথ্যের ওপর নির্ভর করা সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। তাই, হৃদরোগ এবং কোলেস্টেরল সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য সবসময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক