ইউরোপে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়, বাড়ছে উদ্বেগ।
ইউরোপ জুড়ে পর্যটকদের আনাগোনা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। একদিকে যেমন পর্যটন শিল্প ফুলেফেঁপে উঠছে, তেমনি এর খারাপ দিকগুলো নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। পর্যটকদের এই অতিরিক্ত চাপ সেখানকার স্থানীয় জনজীবন, পরিবেশ এবং অবকাঠামোর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
খবর অনুযায়ী, গত বছর প্রায় ৭৪ কোটি ৭০ লক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যটক ইউরোপ ভ্রমণ করেছেন। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে এই সংখ্যা অনেক বেশি। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি পর্যটকের গন্তব্য ছিল দক্ষিণ ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো।
পর্যটকদের এই বিপুল স্রোতের কারণে সেখানকার আবাসন, পানি এবং আকর্ষণীয় স্থানগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। অনেক জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দারা পর্যটকদের ভিড়ের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
পর্যটনের এই বাড়বাড়ন্তের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিমানের টিকিটের দাম কমে যাওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহার করে ভ্রমণের পরিকল্পনা করা সহজ হওয়া এবং উন্নত দেশগুলোর শক্তিশালী অর্থনীতি।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো থেকে আসা পর্যটকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে স্পেন ও ইতালির বার্সেলোনা এবং ভেনিসের মতো জনপ্রিয় স্থানগুলোতে তাদের আনাগোনা বাড়ে। এর ফলে আবাসনের চাহিদা বেড়ে যায়, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে।
ইতালির পর্যটনমন্ত্রী ড্যানিয়েলা সান্টানচে মনে করেন, উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি করতে পারলে পর্যটকদের এই চাপ সামলানো সম্ভব। তিনি জানান, ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারির মতো জনাকীর্ণ স্থানগুলোতে এআই ব্যবহার করে টিকিট বিক্রি এবং ভ্রমণের সময়সূচি নির্ধারণ করা যেতে পারে, যাতে বিশৃঙ্খলা এড়ানো যায়।
ভূমধ্যসাগরের দেশগুলোতে পর্যটকদের চাপ সবচেয়ে বেশি। ফ্রান্স, যেখানে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক পর্যটকের আগমন ঘটে, গত বছর প্রায় ১০ কোটি পর্যটককে স্বাগত জানিয়েছে। স্পেনে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৯ কোটি ৪০ লক্ষ, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ।
স্পেনের ক্যানারি ও বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে, যেখানে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের বাস, সেখানে গত বছর ১ কোটি ৫০ লক্ষের বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছে।
ইতালির ভেনিস, রোম, কাপরি এবং ভেরোনার মতো জনপ্রিয় স্থানগুলোতেও পর্যটকদের অতিরিক্ত ভিড় দেখা যায়। এমনকি গ্রীষ্মকালে অ্যামালফি উপকূলের মতো জায়গায় পর্যটকদের আনাগোনা কমাতে হেলিকপ্টার ও নৌকার ভাড়াও পাওয়া যায়।
গ্রীসে পর্যটকদের সংখ্যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার প্রায় চারগুণ। গ্রীষ্মকালে এখানকার সান্তরিনি, মাইকোনোস এবং অন্যান্য দ্বীপগুলোতে পানি, আবাসন ও বিদ্যুতের সংকট দেখা দেয়।
অতিরিক্ত পর্যটনের কারণে বিভিন্ন শহরে বাড়ির দাম বাড়ছে। পর্যটকদের জন্য স্বল্পমেয়াদি ভাড়ার (short-term rentals) সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের বাড়ি হারাচ্ছে। বার্সেলোনার মতো শহরগুলোতে স্থানীয় দোকানপাট, ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের জায়গায় তৈরি হচ্ছে বিদেশি চেইন শপ ও রেস্টুরেন্ট।
গ্রীসের কিছু দ্বীপে পানির অভাব দেখা দিয়েছে, যা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
ফ্রান্সে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী আসা জাদুঘর লুভর, কর্মীদের ধর্মঘটের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। কর্মীদের অভিযোগ ছিল, অতিরিক্ত পর্যটকদের চাপে জাদুঘরের অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
পর্যটন বিষয়ক গবেষক অ্যাঞ্জেলোস ভারভারুসিস বলেন, অতিরিক্ত পর্যটনের কারণে ইউরোপের অনেক জনপ্রিয় স্থানে একটি “একক সংস্কৃতি” তৈরি হচ্ছে, যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। স্পেনের সরকার জানিয়েছে, তারা Airbnb-কে তাদের প্রায় ৬৬ হাজার সম্পত্তি সরিয়ে নিতে বলেছে, কারণ তারা স্থানীয় নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।
বার্সেলোনা ২০২৮ সালের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ভাড়ার জন্য অনুমোদন দেওয়া ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে। গ্রীসে ১ জুলাই থেকে ক্রুজ জাহাজে আসা পর্যটকদের জন্য মাইকোনোসে ২০ ইউরো (প্রায় ২,৩০০ টাকা) এবং কম জনপ্রিয় দ্বীপগুলোতে ৫ ইউরো (প্রায় ৫৭৫ টাকা) হারে কর ধার্য করা হয়েছে।
এছাড়াও, সরকার পর্যটকদের কম পরিচিত স্থানগুলোতে ভ্রমণ করতে উৎসাহিত করছে। পানির সমস্যা সমাধানে গ্রীসের মূল ভূখণ্ড থেকে ট্যাংকারে করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে এবং সমুদ্রের পানি থেকে লবণ সরিয়ে তা পানযোগ্য করার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভেনিসে দিনভর ভ্রমণকারীদের জন্য প্রবেশ ফি চালু করা হয়েছে, যা ৫ থেকে ১০ ইউরোর মধ্যে (প্রায় ৫৭৫ টাকা থেকে ১,১৫০ টাকা)।
যদিও ইউরোপের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য সরাসরি প্রযোজ্য নাও হতে পারে, তবে কক্সবাজার বা সুন্দরবনের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনার ধারণা নেওয়া যেতে পারে। পর্যটকদের অতিরিক্ত চাপ কিভাবে পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস