ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের আঘাত: আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর এর প্রভাব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রে বিমান হামলা চালিয়েছে। শনিবার রাতের এই হামলায় ইরানের ফোরদো, নাতানজ এবং ইসফাহান শহরে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন সূত্রে এই খবর জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে এই হামলা চালানো হয়। হামলার পর ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো “ধূলিসাৎ” করে দেওয়া হয়েছে। তবে ইরানের পক্ষ থেকে এই হামলার প্রভাবকে কম করে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
ফোরদো: মাটির নিচে সুরক্ষিত কেন্দ্র।
ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্র হলো ফোরদো। এটি মাটির অনেক গভীরে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে সহজে এর ক্ষতি করা না যায়। ধারণা করা হয়, কেন্দ্রটির মূল অংশ মাটির প্রায় ২৬২ থেকে ২৯৫ ফুট নিচে অবস্থিত।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এই গভীরতায় আঘাত হানতে সক্ষম, এমন বোমা ব্যবহার করেছে। মার্কিন বিমান বাহিনী (United States Air Force – ইউএস এয়ার ফোর্স) ছয়টি বি-২ বোমারু বিমান ব্যবহার করে এই স্থাপনায় আঘাত হানে। প্রতিটি বিমানে ছিল প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের “bunker-busting” বোমা।
সিএনএনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, হামলায় ফোরদোর স্থাপনায় অন্তত ছয়টি বড় গর্ত তৈরি হয়েছে, যা বোমাগুলোর আঘাতের প্রমাণ। জাতিসংঘের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (International Atomic Energy Agency – আইএইএ)-এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সিএনএনকে জানান, ফোরদোতে “সরাসরি আঘাত” লেগেছে, তবে ভেতরের ক্ষতির পরিমাণ এখনই বলা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি (Institute for Science and International Security – আইএসআইএস)-এর প্রধান ডেভিড অ্যালব্রাইট সিএনএনকে বলেছেন, স্যাটেলাইট চিত্র থেকে বোঝা যায়, “এলাকাটির সমৃদ্ধকরণ হল এবং এর সংলগ্ন হলগুলোতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।” তিনি আরও জানান, “ভূগর্ভস্থ হল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।”
নাতানজ: বৃহত্তম কেন্দ্র।
নাতানজ হলো ইরানের বৃহত্তম পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এর আগে, গত ১৩ই জুন ইসরায়েল এই কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছিল। এই কেন্দ্রে ছয়টি ভবন এবং তিনটি ভূগর্ভস্থ কাঠামো রয়েছে, যেখানে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সেন্ট্রিফিউজ স্থাপন করা হয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় এখানকার কিছু অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র নাতানজেও হামলা চালিয়েছে। একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একটি বি-২ বোমারু বিমান এই কেন্দ্রে “bunker-busting” বোমা ফেলেছে। এছাড়াও, মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে নাতানজ এবং ইসফাহানে ৩০টি টিএলএএম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র (TLAM cruise missiles) নিক্ষেপ করা হয়েছে।
ইসফাহান: গবেষণা কেন্দ্র।
ইরানের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত ইসফাহান শহরে দেশটির বৃহত্তম পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। ১৯৮৪ সালে চীনের সহায়তায় এটি নির্মিত হয়েছিল। নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ (Nuclear Threat Initiative – এনটিআই) অনুসারে, এখানে প্রায় ৩ হাজার বিজ্ঞানী কাজ করেন এবং এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
আর্ন্তজাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইসফাহানের কাছে টানেল কমপ্লেক্সেও আঘাত হানা হয়েছে, যেখানে সাধারণত ২০% এবং ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সংরক্ষণ করা হয়। অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম ৯০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ করা হয়।
ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক।
ইরানের কর্মকর্তারা হামলার প্রভাবকে লঘু করে দেখালেও, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। তাদের মতে, স্যাটেলাইট চিত্র থেকে ক্ষতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। তবে ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করতে আরও সময় লাগবে।
আঞ্চলিক প্রভাব।
এই হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। ইরানের পক্ষ থেকে এর প্রতিশোধ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন