মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে চলেছে। চিলির আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে স্থাপিত অত্যাধুনিক ‘ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরি’ সম্প্রতি তার প্রথম ছবি প্রকাশ করেছে, যা বিশ্বজুড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ তৈরি করেছে।
এই নতুন টেলিস্কোপ মহাকাশের গভীরে থাকা নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এবং বিভিন্ন জ্যোতিষ্ক সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও অনেক বাড়িয়ে দেবে।
এই অবজারভেটরি তৈরি করা হয়েছে একটি বিশাল টেলিস্কোপ এবং অত্যাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরার সমন্বয়ে। সিমোনি সার্ভে টেলিস্কোপ নামক বিশাল যন্ত্রটি যুক্ত রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এবং উচ্চ রেজোলিউশনের ডিজিটাল ক্যামেরার সঙ্গে।
এই ক্যামেরার ক্ষমতা ৩২০০ মেগাপিক্সেল, যা বিশাল আকাশের ছবি তুলতে সক্ষম। এই টেলিস্কোপের ২৭ ফুটের প্রধান আয়না ব্যবহার করে, এটি মাত্র ৩০ সেকেন্ডের এক্সপোজারে আকাশের বিশাল অংশজুড়ে ছবি তুলতে পারে।
প্রতিটি ছবি ৪০টি চাঁদের আকারের সমান এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই অবজারভেটরির মাধ্যমে তাঁরা রাতের আকাশের একটি নতুন, অত্যন্ত বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করতে পারবেন। আগামী দশ বছর ধরে, প্রতি তিন রাত অন্তর অন্তর, এটি পুরো দৃশ্যমান দক্ষিণ আকাশের ছবি তুলবে।
এর ফলে, মহাকাশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে চলা পরিবর্তনগুলি স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। বিজ্ঞানীরা এই ডেটা ব্যবহার করে কোটি কোটি নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সির ছবি তৈরি করতে পারবেন।
এমনকি, কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিগুলোও এতে দেখা সম্ভব হবে।
প্রকাশিত প্রথম ছবিগুলোতে নেবুলা এবং গ্যালাক্সির ছবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে ‘ল্যাগুন নেবুলা’ ও ‘ট্রাইফাইড নেবুলা’।
এই গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘগুলি যথাক্রমে ৪,৩৫০ এবং ৪,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এছাড়াও, ‘ভারগো ক্লাস্টার’-এর ছবিগুলিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এই ক্লাস্টারে প্রায় ২,০০০ উপবৃত্তাকার ও সর্পিল গ্যালাক্সি রয়েছে। ছবিতে গ্যালাক্সির সংঘর্ষের দৃশ্যও দেখা গেছে, যা গ্যালাক্সির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই অবজারভেটরির ডেটা বিশ্লেষণ করার জন্য শক্তিশালী কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হবে। কারণ, প্রতি রাতে এটি প্রায় ২০ টেরাবাইট ডেটা তৈরি করবে, যা ম্যানুয়ালি বিশ্লেষণ করা কঠিন।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এর মাধ্যমে সৌরজগতের গ্রহাণু এবং ধূমকেতু চিহ্নিত করা, দূরের নক্ষত্রের বিস্ফোরণ ও ব্ল্যাকহোল অনুসন্ধান করা সহজ হবে।
ভবিষ্যতে, এটি ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি-র মতো মহাকাশের রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করবে।
এই প্রকল্পের নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা সি. রুবিনের নামে। তিনি ডার্ক ম্যাটার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন।
২০১৪ সালে চিলির সেরো প্যাচন-এ এই অবজারভেটরির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। এটি মূলত ‘লার্জ সিনোপটিক সার্ভে টেলিস্কোপ’ নামে পরিচিত ছিল, যা ২০১৯ সালে ভেরা রুবিনের সম্মানে নতুন নামকরণ করা হয়।
২০২৫ সাল থেকে এই অবজারভেটরি পুরোদমে কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরির প্রথম ছবিগুলো মহাকাশ গবেষণায় একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের অজানা রহস্য উন্মোচন করতে পারবেন এবং আমাদের সৌরজগতের বাইরে থাকা গ্রহ, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি সম্পর্কে নতুন তথ্য জানতে পারবেন।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক