যুদ্ধাহত মেরিন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, শিশুকে স্তন্যপান করা অবস্থায় আটক করলো অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
ব্যাটন রুজ, লুইজিয়ানা – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন মেরিন সেনা কর্মকর্তা, অ্যাড্রিয়ান ক্লুয়েট্রে, জানেন না কিভাবে তার সন্তানদের বলবেন তাদের মা কোথায় গিয়েছেন। গত মাসে ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) কর্মকর্তাদের হাতে তার স্ত্রী আটকের শিকার হয়েছেন।
ছোট্ট ছেলে নোয়াহ যখন রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের কথা জানতে চায়, অ্যাড্রিয়ান তাকে শুধু বলেন, “মা খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে।” আর যখন তার তিন মাস বয়সী কন্যা সন্তান লিন ক্ষুধার্ত হয়, তখন তিনি ফর্মুলা দুধের বোতল দেন, কারণ মা নেই।
মায়ের ত্বক-থেকে-ত্বকের সংস্পর্শের অভাবে কীভাবে তার নবজাতকের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক তৈরি হবে, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত।
ট্রাম্প প্রশাসন প্রতিদিন প্রায় ৩,০০০ জনকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। আর এই তালিকায় পাওলা ক্লুয়েট্রে-র মতো আরও হাজারো মানুষ রয়েছেন, যারা বর্তমানে আটক অবস্থায় আছেন এবং তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার সম্ভাবনা রয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসন সংক্রান্ত কঠোর নীতিমালার কারণে সামরিক বাহিনীর পরিবারগুলোর প্রতি নমনীয়তা দেখানোর যে চল ছিল, তা এখন কমে গেছে। এমনকি, সামরিক পরিবারের সদস্যদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য গঠিত ফেডারেল সংস্থাগুলোও এখন তাদের বিতাড়িত করার জন্য সুপারিশ করছে।
স্ত্রীকে দেখতে হলে অ্যাড্রিয়ান ক্লুয়েট্রে-কে লুইজিয়ানার ব্যাটুন রুজ থেকে আট ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে একটি গ্রামীণ আইসিই ডিটেনশন সেন্টারে যেতে হয়। অ্যাড্রিয়ান একজন যুদ্ধাহত সেনা, তাই তিনি সুযোগ পেলেই সেখানে যান।
পাওলা ক্লুয়েট্রে, ২৫ বছর বয়সী একজন মেক্সিকান নাগরিক। এক দশকেরও বেশি আগে, তার মা তাকে আশ্রয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসেন। অ্যাড্রিয়ান ক্লুয়েট্রে-র সাথে তার প্রথম দেখা হয় ক্যালিফোর্নিয়ার একটি নাইটক্লাবে, যখন অ্যাড্রিয়ান পাঁচ বছরের সামরিক জীবন শেষ করার পথে ছিলেন।
তারা দু’জনেই ২০২২ সালে একে অপরের নাম হাতে ট্যাটু করেছিলেন। ২০২৪ সালে তাদের বিয়ে হয়।
এরপর পাওলা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাস ও কাজ করার জন্য গ্রিন কার্ডের আবেদন করেন। অ্যাড্রিয়ান ক্লুয়েট্রে জানান, তিনি খুব একটা রাজনীতিক নন, তবে তার স্ত্রী যে এখানে বৈধভাবে বসবাসের যোগ্য, তা তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, “আমি সবসময় চাই যে অপরাধীরা দেশ থেকে বিতাড়িত হোক। কিন্তু যারা এখানে কঠোর পরিশ্রম করে, বিশেষ করে যারা আমেরিকানদের সঙ্গে বিবাহিত, তাদের গ্রিন কার্ড পাওয়া উচিত।”
পাওলার গ্রিন কার্ডের আবেদন প্রথমে ভালোভাবে চললেও, পরে জানা যায় যে ২০১৮ সালে তার মায়ের একটি অভিবাসন শুনানিতে হাজির না হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নির্দেশ জারি করা হয়েছিল।
অ্যাড্রিয়ান জানান, পাওলার মা এবং তার মধ্যে কয়েক বছর ধরে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এমনকি, কয়েক মাস আগেও পাওলা তার মায়ের শুনানিতে অনুপস্থিতি বা দেশত্যাগের আদেশের বিষয়ে কিছুই জানতেন না।
অ্যাড্রিয়ান ক্লুয়েট্রে-র স্মৃতিচারণ করে বলেন, একটি গ্রিন কার্ড আবেদনের অংশ হিসেবে, ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেসের একজন কর্মী মে মাসের ২৭ তারিখে তাদের একটি অ্যাপয়েন্টমেন্টে দেশত্যাগের আদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। পাওলা ক্লুয়েট্রে জানান, তিনি তার মামলাটি পুনরায় চালু করার চেষ্টা করছেন।
এরপর ওই কর্মী তাকে এবং তার স্বামীকে ফলো-আপ অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য লবিতে অপেক্ষা করতে বলেন। অ্যাড্রিয়ান মনে করেন, এটি ছিল একটি কৌশল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্মকর্তারা এসে পাওলার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন। তখন পাওলা তার বিয়ের আংটি স্বামীর কাছে জমা দিয়ে দেন, যেন তিনি সেটি নিরাপদে রাখতে পারেন।
অশ্রুসজল চোখে অ্যাড্রিয়ান ক্লুয়েট্রে বলেন, তিনি এবং তার স্ত্রী “সঠিক কাজটি” করার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তিনি বুঝতে পারেন যে আইসিই কর্মকর্তারা তাদের কাজ করছেন, তবুও তাদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে আরও বিচক্ষণ হওয়া উচিত ছিল।
পাওলার আইনজীবী, প্রাক্তন অভিবাসন বিচারক কেরি হলিডে বলেন, “একজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে এমন আচরণ করাটা খুবই দুঃখজনক। আপনি তার স্ত্রীকে ধরে নিয়ে মেক্সিকোতে ফেরত পাঠাচ্ছেন?”
পাওলার দেশত্যাগের আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য ক্লুয়েট্রে দম্পতি ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ইমিগ্রেশন আদালতে আবেদন করেছেন এবং তারা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছেন, হলিডে জানান।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের মুখপাত্র ট্রিয়া ম্যাখলাফলিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, পাওলা ক্লুয়েট্রে “অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করেছেন”। প্রশাসন “আইনের শাসনকে উপেক্ষা করবে না।”
ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউএসসিআইএস) ৯ জুন এক পোস্টে জানায়, “যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় নিরাপদ করার ক্ষেত্রে, সরকারের দীর্ঘ স্মৃতি রয়েছে এবং অবাধ্যতার প্রতি কোনো সহানুভুতি নেই।” এটি ক্লুয়েট্রে-র মামলার কথা উল্লেখ করে থাকতে পারে।
অ্যাড্রিয়ান ক্লুয়েট্রে বলেন, ইউএসসিআইএস-এর পোস্টটি তার স্ত্রীর পরিস্থিতির সঠিক চিত্র দেয় না। কারণ, তিনি একজন নাবালক হিসেবে তার মায়ের সঙ্গে আশ্রয়ের জন্য এসেছিলেন।
তিনি বলেন, “তিনি বহিষ্কারের আদেশের বিষয়ে অবগত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এটি অমান্য করেননি। যদি তাকে গ্রেপ্তার করা হতো, তবে তাকে অনেক আগেই বিতাড়িত করা হতো এবং আমাদের কখনোই দেখা হতো না।”
হলিডে এবং সামরিক অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞ মার্গারেট স্টক জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের বিতাড়ন বাড়ানোর আগে, ইউএসসিআইএস সামরিক বাহিনীর পরিবারগুলোর সদস্যদের আইনি সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি নমনীয়তা দেখাতো।
২৮ ফেব্রুয়ারির একটি স্মারকলিপিতে, সংস্থাটি জানায় যে, পূর্বে যে গোষ্ঠীগুলোকে ছাড় দেওয়া হতো, তাদের আর বিতাড়িত করা হবে না। এর মধ্যে সামরিক কর্মী বা ভেটেরানদের পরিবারও অন্তর্ভুক্ত।
১২ জুনের হিসাব অনুযায়ী, সংস্থাটি প্রায় ২৬,০০০ এর বেশি মামলা আইসিই-কে বিতাড়নের জন্য পাঠিয়েছে।
ইউএসসিআইএস এখনও সামরিক বাহিনীর পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি প্রোগ্রাম সরবরাহ করে, যারা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে তারা গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করার সময় দেশে থাকতে পারে।
কিন্তু পাওলা ক্লুয়েট্রে-র মতো একজন ভেটেরানের স্ত্রীর ক্ষেত্রে, এখন আর কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। স্টক এমনটাই বলছেন।
অন্যদিকে, মেরিন কর্পসের বেশ কয়েকজন নিয়োগকর্তা, ল্যাটিনোদের উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন পোস্ট করেছেন, যেখানে পরিবারের সদস্যদের জন্য “দেশত্যাগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা” পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রচার করা হচ্ছে।
স্টক বলেন, “আমার মনে হয়, যখন প্রশাসন আর এই ধরনের সুবিধা দিচ্ছে না, তখন তাদের এমন বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত নয়। এটি নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছে ভুল বার্তা পাঠায়।”
মেরিন কর্পসের মুখপাত্র মাস্টার সার্জেন্ট টাইলার হাভাক অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন, নিয়োগকারীদের জানানো হয়েছে যে, তারা “আবেদনকারী বা তাদের পরিবারের জন্য অভিবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে” এমন ইঙ্গিত দেওয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নন।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস