যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগের কারণে গবেষণা খাতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ায় ক্যান্সার ও হৃদরোগের চিকিৎসাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খবরটি দিয়েছে সিএনএন।
শিকাগোর কাছাকাছি বসবাসকারী ৭৪ বছর বয়সী অ্যাঞ্জেলিনা ব্রাউন হৃদরোগের একটি বিশেষ অবস্থা ‘অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন’ (Atrial Fibrillation) বা এএফিবির (AFib) শিকার। এই রোগে হৃদপিণ্ডের উপরের প্রকোষ্ঠ অনিয়মিতভাবে স্পন্দিত হতে থাকে।
এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বাড়ে, যা স্ট্রোক ও হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাসের কারণ হতে পারে। ব্রাউন এই রোগের ঝুঁকি কমাতে রক্ত তরল করার ওষুধ সেবন করতেন।
কিন্তু তাঁর মতে, এর কিছু খারাপ প্রভাব ছিল। যেমন— সামান্য আঘাতে তাঁর শরীরে কালশিটে পড়ত এবং রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে অনেক সময় লাগত।
চিকিৎসক ও গবেষক ড. রড পাসম্যান এএফিবির রোগীদের জন্য নতুন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি উত্তর-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (Northwestern University) একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ।
তাঁর নতুন গবেষণায়, এএফিবির রোগীদের জন্য একটি বিশেষ অ্যাপল ওয়াচ ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের হৃদস্পন্দন নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হতো এবং প্রয়োজন অনুযায়ী রক্ত তরল করার ওষুধ দেওয়া হতো।
ড. পাসমান মনে করেন, ‘সব এএফিবির রোগীকেই আজীবন একই ধরনের ওষুধ দেওয়াটা সঠিক নয়।’
এই গবেষণায় ব্রাউন প্রথম রোগী ছিলেন এবং বর্তমানে ১,৭০০ জনের বেশি রোগী এতে যুক্ত হয়েছেন। এই গবেষণা সফল হলে, এটি এএফিবির চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এবং রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে।
এতে একদিকে যেমন ওষুধের ব্যবহার কমবে, তেমনি কমবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিও। ড. পাসমান এই গবেষণা থেকে ভালো ফল পাওয়ার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী ছিলেন।
কিন্তু এখন তাঁর এই গবেষণার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ, গবেষণাটির জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলারের তহবিল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (National Institutes of Health – NIH)।
উত্তর-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মতে, মার্চ মাস থেকে তারা এই ফেডারেল সংস্থা থেকে কোনো অর্থ সহায়তা পাননি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে গবেষণা খাতে অর্থায়ন স্থগিত করা হয়েছে।
শুধু উত্তর-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, হার্ভার্ড, কর্নেল ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা তহবিলেও একই ধরনের স্থগিতাদেশ এসেছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল স্থগিত করার কারণ হিসেবে জানা যায়, সেখানে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে পুষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ নিয়ে চলমান গবেষণাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এনআইএইচের পরিচালক ড. জয় ভট্টাচার্য্য জানিয়েছেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে তাঁরা খেয়াল রাখছেন।
তবে উত্তর-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান আসেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, স্থগিতাদেশের কারণে গবেষণা প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিশেষ করে, ক্যান্সারের ওপর চলমান বিভিন্ন গবেষণা, যেমন— মস্তিষ্ক, কোলন, স্তন ও শিশুদের ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ক্যান্সার গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. সীমা খানের মতে, এই পরিস্থিতিতে তাঁদের গবেষণা কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই গবেষণার অধীনে বর্তমানে মেটফর্মিন (Metformin) নামক একটি ডায়াবেটিসের ওষুধ ব্যবহার করে ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধের সম্ভাবনা যাচাই করা হচ্ছে।
এছাড়া, লিনচ সিনড্রোম (Lynch syndrome) আক্রান্ত রোগীদের ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য একটি ভ্যাকসিন নিয়েও কাজ চলছে।
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের জন্য ট্যামোক্সিফেন (Tamoxifen) নামক ওষুধের সঠিক ডোজ নির্ণয়ের পরীক্ষাও চলছে।
এই পরিস্থিতিতে, গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন বিকল্পের কথা ভাবছেন। কিন্তু তহবিল বন্ধ থাকার কারণে তাঁদের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এএফিবির প্রথম রোগী অ্যাঞ্জেলিনা ব্রাউন জানান, তিনি এই গবেষণায় যুক্ত হয়ে খুবই উপকৃত হয়েছেন।
তিনি চান, গবেষণাটি যেন কোনোভাবে বন্ধ না হয়ে যায় এবং তাঁর মতো রোগীদের জন্য এটি একটি আশার আলো হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, এনআইএইচ এই গবেষণা প্রকল্পের জন্য দ্রুত অর্থ ছাড় করবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা হয়তো এই ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না।’
তথ্য সূত্র: সিএনএন