যুদ্ধবিরতির অচলাবস্থা: গাজায় হামাসের উপর নতুন পরিকল্পনা চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল
গাজায় যুদ্ধবিরতি এখনো ঝুলে আছে। এর মধ্যেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের উপর নতুন একটি পরিকল্পনা চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই প্রস্তাবকে “উইটকফ প্রস্তাব” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। যদিও হোয়াইট হাউস এখনো পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে ইসরায়েলের যেকোনো পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে তারা।
গত জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যেই নেতানিয়াহুর এই মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, হামাসকে তাদের হাতে থাকা জিম্মিদের অর্ধেককে মুক্তি দিতে হবে। এর বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি বাড়ানো এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তির আলোচনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। তবে, ইসরায়েল এই চুক্তিতে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেনি, যা আগের চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
অন্যদিকে, হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান চুক্তিকে বানচাল করার চেষ্টা করার অভিযোগ করেছে। তাদের দাবি, আগের চুক্তিতে জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি।
রবিবার, ইসরায়েল গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও অন্যান্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। হামাস নতুন প্রস্তাব গ্রহণ না করলে “আরও কঠিন পরিণতি” ভোগ করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাব
যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার জন্য ট্রাম্প একটি ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি গাজার জনসংখ্যাকে অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র তৈরির কথা বলেছেন। যদিও আরব দেশগুলোসহ ফিলিস্তিনি এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে।
তবে, যুদ্ধ যদি আবার শুরু হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের আগের হামলায় গাজার অধিকাংশ এলাকা ধ্বংস হয়ে যায় এবং প্রায় ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু ছিল।
যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ
যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতায় হওয়া জানুয়ারির যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তিনটি পর্যায়ে জিম্মিদের মুক্তি এবং যুদ্ধের সমাপ্তির কথা বলা হয়েছিল। হামাস ৭ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১,২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে। এর মধ্যে ১০০ জনের বেশিকে আগের যুদ্ধবিরতিতে মুক্তি দেওয়া হয়। ইসরায়েলি বাহিনী জীবিত ৮ জনকে উদ্ধার করে এবং অনেকের মরদেহও উদ্ধার করে।
প্রথম ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতিতে হামাস ইসরায়েলের ২৫ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেয় এবং আরও ৮ জনের মরদেহ হস্তান্তর করে। এর বিনিময়ে প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল। ইসরায়েলি বাহিনী গাজার অধিকাংশ এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেয়। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ করলেও, চুক্তিটি বহাল ছিল।
দ্বিতীয় ধাপ ছিল সবচেয়ে কঠিন। কারণ, এতে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা এবং হামাসকে নির্মূল করার মধ্যে ইসরায়েলকে একটি বেছে নিতে হতো। হামাস এখনো গাজার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং তারা জানিয়েছে, ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ করলে তবেই তারা অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেবে। কিন্তু এতে হামাস টিকে থাকবে এবং গাজায় তাদের প্রভাব বজায় থাকবে।
নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক কৌশল
নেতানিয়াহুর জোট সরকার চরম ডানপন্থী দলগুলোর উপর নির্ভরশীল। এই দলগুলো হামাসকে নির্মূল করতে, গাজার জনসংখ্যাকে “স্বেচ্ছায়” সরিয়ে দিতে এবং সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন করতে চায়। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, নেতানিয়াহু যদি আগের চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করেন এবং যুদ্ধ পুনরায় শুরু না করেন, তাহলে তিনি সরকার ভেঙে দেবেন।
নতুন পরিকল্পনা নেতানিয়াহুকে ছয় সপ্তাহের জন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তিনি বাজেট পাস করারও সময় পাবেন, যা তার সরকারের টিকে থাকার জন্য জরুরি। বিরোধী দলগুলো জানিয়েছে, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার চুক্তির ক্ষেত্রে তারা নেতানিয়াহুর সরকারকে সমর্থন করবে, কিন্তু এতে তার রাজনৈতিক দুর্বলতা বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়
নেতানিয়াহু বলেছেন, তার সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে “পূর্ণ সমন্বয়” করেই কাজ করছে। কিন্তু উইটকফ এই প্রস্তাব নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস