চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ: ২০২৫ সালের জন্য উচ্চাভিলাষী ৫% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ চীনের
বিশ্ব অর্থনীতির দুই পরাশক্তি – চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ আরও তীব্র রূপ নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, চীন ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বেইজিং মনে করছে, এই লক্ষ্য তাদের দৃঢ়তা এবং যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলার মানসিকতার পরিচায়ক।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বুধবার দেশটির জাতীয় গণ কংগ্রেসের (এনপিসি) উদ্বোধনী অধিবেশনে সরকারের কর্ম-প্রতিবেদন পেশ করেন। সেখানে তিনি এই লক্ষ্যের কথা জানান। এই সময়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম কংগ্রেসে ভাষণ দিচ্ছিলেন, যা দুই দেশের মধ্যেকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতারই একটি চিত্র তুলে ধরে। উভয় নেতাই তাদের নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের রূপরেখা তুলে ধরেন।
চীনের গ্রেট হল অফ দ্য পিপলের অভ্যন্তরে একতা ও দৃঢ়তার চিত্র ফুটে ওঠে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং শীর্ষ নেতৃত্ব, সকলে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানানোর মধ্যে দিয়ে মূল মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। লি কেকিয়াংয়ের বক্তব্যেও ছিল সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। বিশ্লেষকদের মতে, চীন এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের দায়িত্বশীল ও আত্মবিশ্বাসী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে।
প্রধানমন্ত্রী লি তার ভাষণে বলেন, “শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে এবং দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, আমরা উন্নয়নের পথে যে কোনো বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হব।” তিনি আরও বলেন, “চীনের অর্থনীতির বিশাল জাহাজ ভবিষ্যতের দিকে অবিচলভাবে এগিয়ে চলবে।” যদিও লি তার ভাষণে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেননি, তবে তিনি বিশ্ব অর্থনীতিতে শুল্কের প্রভাব এবং পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন।
চীনের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা মূলত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চাপকে উপেক্ষা করে তাদের পথ ধরে রাখারই ইঙ্গিত। ট্রাম্প প্রশাসনের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে।
গত মঙ্গলবার, ট্রাম্প প্রশাসন চীনের সকল পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক দ্বিগুণ করে ২০ শতাংশে উন্নীত করেছে। এর কয়েক দিন আগে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের প্রযুক্তি খাতে চীনের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের হুমকি দেয়। এর জবাবে চীনও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কিছু মার্কিন পণ্যের উপর ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে। এছাড়াও, তারা বেশ কয়েকটি মার্কিন কোম্পানির রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ জোরদার করে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ দায়ের করে। একইসঙ্গে, তিনটি মার্কিন কোম্পানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাঠ ও সয়াবিন আমদানিও স্থগিত করা হয়।
চীনের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক যুদ্ধ বা অন্য কোনো ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, তবে চীন শেষ পর্যন্ত লড়বে।”
তবে, শুল্ক বৃদ্ধি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞার হুমকির কারণে চীনের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারেও চাহিদা কমেছে, যা বেইজিংয়ের জন্য উদ্বেগের কারণ।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং তার ভাষণে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দুর্বলতাগুলোও স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “বহিরাগত পরিস্থিতি আরও জটিল এবং গুরুতর হয়ে উঠছে, যা দেশের বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।”
পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীন তার বাজেট ঘাটতি জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। একইসঙ্গে, তারা বার্ষিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রায় ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।
চীনের অর্থনীতি বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা যেমন—ভোগের দুর্বলতা, স্থানীয় সরকারের ঋণের বোঝা, বিদেশি বিনিয়োগে পতন এবং যুবকদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের সঙ্গে লড়াই করছে।
যদিও চীনের অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, দেশটি প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী লি বলেন, “আমরা উদীয়মান শিল্প এবং ভবিষ্যতের শিল্পগুলোকে উৎসাহিত করব।” তিনি আরও বলেন, তারা জৈব-উৎপাদন, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, এম্বেডেড এআই এবং ৬জি প্রযুক্তির মতো শিল্পের জন্য তহবিল বাড়ানোর ব্যবস্থা তৈরি করবে। সেইসঙ্গে, বৃহৎ আকারের এআই মডেলগুলোর ব্যাপক প্রয়োগ এবং স্মার্ট উৎপাদন সরঞ্জাম তৈরি করারও অঙ্গীকার করেন তিনি। এর মধ্যে এআই-চালিত নতুন প্রজন্মের যানবাহন এবং রোবট তৈরির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
চীন মনে করে, অত্যাধুনিক চিপস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রোবোটিক্স এবং এআই তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং উৎপাদন খাতে উন্নতি আনবে। প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার ২০২৫ সালের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ৩৯৮ বিলিয়ন ইউয়ানের (প্রায় ৫৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাজেট বরাদ্দ করেছে, যা গত বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
চীনের এই পদক্ষেপগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য বিরোধের প্রেক্ষাপটে নেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো চীনের “বিশ্বের কারখানা” হিসেবে যে পরিচিতি, তাকে দুর্বল করা।
রেললাইন, গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে। তাই, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
এছাড়াও, চীন ২০২৫ সালের সামরিক বাজেট ৭.২ শতাংশ বাড়িয়ে ১.৭৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) করার ঘোষণা দিয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন