পিঠার দেশ, বাংলাদেশের মানুষের কাছে খাবার মানেই উৎসব। আর এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল হরেক রকমের পিঠা। শীতকালে যেমন নানা স্বাদের পিঠার আয়োজন হয়, তেমনি সারা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে খাবারের এই অনবদ্য পদটির ভিন্ন রূপ দেখা যায়।
আসুন, আজ আমরা ঘুরে আসি বিশ্বের নানা প্রান্তের কিছু অসাধারণ প্যানকেকের জগৎ থেকে।
ফ্রান্স ও ইতালির ‘সোকা’ (Socca): ছোলা বা বেসন, জল, জলপাই তেল ও মশলা দিয়ে তৈরি এই প্যানকেকটি একদিকে যেমন হালকা, তেমনই পুষ্টিকর। ঐতিহ্যগতভাবে কাঠের আগুনে পোড়ানো বড় কড়াইয়ে এটি তৈরি করা হয়। যারা গ্লুটেন (gluten) যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলেন, তাঁদের জন্য এটি একটি দারুণ বিকল্প।
রাশিয়ার ‘ব্লিনি’ (Blinis): এই পাতলা, গোল আকারের প্যানকেকগুলো তৈরি হয় বাকউইট (buckwheat) ময়দা এবং ইস্ট দিয়ে। সাধারণত এটি ছোট আকারের হলেও, রাশিয়ান রেস্তোরাঁগুলোতে ক্যাভিয়ার (caviar) বা স্মোকড স্যামন (smoked salmon)-এর সাথে পরিবেশন করা হয়। মাসলেনিৎসা (Maslenitsa) বা ‘প্যানকেক সপ্তাহ’ উপলক্ষে এই খাবারটির বিশেষ কদর দেখা যায়।
সুইজারল্যান্ডের ‘হেম্প প্রোটিন প্যানকেক’ (Hemp protein pancakes): স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের জন্য সুইস শেফ সভেন ভ্যাসমারের (Sven Wassmer) তৈরি করা এই প্যানকেকটি বেশ জনপ্রিয়। গ্লুটেন-মুক্ত এই প্যানকেক তৈরিতে ময়দার বদলে ব্যবহার করা হয় হেম্প প্রোটিন। এর সাথে থাকে কলা, বাদাম, ম্যাপেল সিরাপ এবং সামান্য হুইপড ক্রিম।
জাপানের ‘ফ্লাফি প্যানকেক’ (Fluffy pancakes): নামেই এর পরিচয়। ‘হটটোকেকি’ (Hottokeki) নামে পরিচিত এই প্যানকেকগুলো এতটাই নরম ও তুলতুলে হয় যে, এটি দেখতে অনেকটা সুফলের (souffle) মতো। ডিমের সাদা অংশ দিয়ে তৈরি মেরিং (meringue) ব্যবহার করার কারণে এর গঠন হয় খুবই আকর্ষণীয়। ফল, ক্রিম, ম্যাপেল সিরাপ বা বেকন দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয় এই সুস্বাদু খাবারটি।
চীনের ‘স্ক্যালিয়ন প্যানকেক’ (Scallion pancakes): অন্যান্য প্যানকেকের থেকে এটি একটু ভিন্ন। সাধারণত ময়দার বদলে এই প্যানকেক তৈরি হয় খামির দিয়ে। ফলে এটি হয় কুড়কুড়ে, হালকা এবং চিবানো যায় এমন। সোয়া সস বা চিলি সসের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়। সাংহাইয়ের সংস্করণে শুকরের মাংসের চর্বি ব্যবহার করা হয়, যা এর স্বাদ আরও বাড়ায়।
ফ্রান্সের ‘ক্র্যাপ’ (Crepes): ফরাসি ক্র্যাপ যদি প্যানকেকের তালিকায় না থাকে, তবে সেটি সত্যিই আশ্চর্যের। উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের ব্রিটানি (Brittany) অঞ্চলে ত্রয়োদশ শতকে এর উদ্ভব। মিষ্টি স্বাদের জন্য ফল, সিরাপ বা চকোলেট এবং নোনতা স্বাদের জন্য হ্যাম ও চিজের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাটারমিল্ক প্যানকেক’ (Buttermilk pancakes): ঘন এবং তুলতুলে এই প্যানকেকগুলো ম্যাপেল সিরাপ ও ক্রিস্পি বেকন দিয়ে পরিবেশন করা হয়। ১৮ শতকে প্রকাশিত ‘আমেরিকান কুকেরি’ (American Cookery)-তে এই প্যানকেকের রেসিপি পাওয়া যায়। বাটারমিল্ক ব্যবহারের কারণে এটি নরম হয় এবং এতে হালকা টক স্বাদ পাওয়া যায়।
ইসরায়েলের ‘ল্যাটকেস’ (Latkes): আশকেনাজি (Ashkenazi) ইহুদিদের একটি জনপ্রিয় খাবার হল ল্যাটকেস। আলু, পেঁয়াজ এবং ডিম দিয়ে তৈরি এই খাবারটি টক ক্রিম, আপেল সস বা লক্স-এর সাথে পরিবেশন করা হয়।
ভারতের ‘মাসালা দোসা’ (Masala Dosa): দক্ষিণ ভারতে খুবই জনপ্রিয় একটি প্রাতরাশের পদ হল মাসালা দোসা। চাল ও মসুর ডাল দিয়ে তৈরি করা হয় এই প্যানকেক। এর ভেতরে আলু, সরিষার বীজ, নারকেল, হলুদ ও ধনে পাতার পুর দেওয়া হয়। নারকেল, টমেটো, ধনে পাতা বা বাদামের চাটনির সাথে এটি পরিবেশন করা হয়।
ইংল্যান্ডের ‘চিনি ও লেবুর প্যানকেক’ (Sugar and lemon pancakes): ব্রিটিশরা এই প্যানকেকটিকে ‘প্যানকেক ডে’-তে তৈরি করে থাকে। এটি আকারে ছোট ও পাতলা হয় এবং সাধারণত লেবুর রস ও চিনি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
চীনের ‘পেকিং ডাক-এর প্যানকেক’ (Pancakes with Peking duck): চীনের আরেকটি জনপ্রিয় প্যানকেক হল পেকিং ডাক-এর সাথে পরিবেশিত পাতলা আটার রুটি। ময়দা, জল ও নুন দিয়ে তৈরি এই প্যানকেকগুলো স্টিমারে সেদ্ধ করা হয়। এরপর হাঁসের মাংস, পেঁয়াজ এবং মিষ্টি সস দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
ইথিওপিয়ার ‘ইনজেরা’ (Injera): এটি মূলত এক ধরণের ফ্ল্যাটব্রেড, তবে প্যানকেকের মতোই জনপ্রিয়। টেফ (teff) ময়দা, জল এবং ‘এর্শো’ (ersho) দিয়ে তৈরি এই খাবারটি কিছুটা স্পঞ্জি ও হালকা টক স্বাদের হয়। এটি তৈরি করার জন্য একটি গোলাকার পাত্রে মিশ্রণটি ঢেলে দেওয়া হয়, যার ফলে এর উপরিভাগ ছিদ্রযুক্ত হয়।
ফ্রান্সের ব্রিটানির ‘গালেট’ (Galettes): এই অঞ্চলের মানুষজন এই প্যানকেকটি তৈরি করতে খুবই গর্বিত। এটি স্বাস্থ্যকর বাকউইট ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয় এবং এর ভেতরে হ্যাম, ডিম, বেকন বা চিজের পুর দেওয়া হয়। আপেল সিডারের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডাচ বেবি’ (Dutch Baby): ওয়াশিংটন রাজ্যে খুবই জনপ্রিয় এই প্যানকেকটি। এটি বেক করা হয় এবং বাটার, চিনি, লেবু বা সিরাপ দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
সুইজারল্যান্ডের ‘কোলেরমাস’ (Cholermus): সুইস ক্যান্টন অবওয়াল্ডেন-এর এই প্যানকেকগুলো সাধারণত রাতের খাবারে পরিবেশন করা হয়। বাটারে রান্না করার পর, এটি ছোট ছোট টুকরো করে কেটে চিনি, দারুচিনি এবং আপেল সসের সাথে পরিবেশন করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার ‘পিকলেটস’ (Pikelets): এই ছোট ও তুলতুলে প্যানকেকগুলো অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতির একটি অংশ। বেকিং পাউডার ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়। সোনালি হয়ে এলে ক্রিম, চিনি এবং স্ট্রবেরি বা স্ট্রবেরি জেলি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
কোরিয়ার ‘কিমচি প্যানকেক’ (Kimchi pancakes): এটি একটি সুস্বাদু নোনতা প্যানকেক। কিমচি, ময়দা, ডিম এবং অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি এই প্যানকেকটি গরম, মশলাদার ও কুড়কুড়ে হয়।
ভেনেজুয়েলার ‘ক্যাচাপাস’ (Cachapas): ভেনেজুয়েলার এই প্যানকেকগুলো ভুট্টা দিয়ে তৈরি করা হয়। ভুট্টা বাটা, পনির এবং মাখন ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়। সোনালি হওয়া পর্যন্ত ভেজে, ‘কুয়েসো দে মানো’ (queso de mano) পনির দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
এভাবে, বিশ্বজুড়ে প্যানকেকের রয়েছে বিচিত্র স্বাদ ও রূপ। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী, এই প্যানকেকগুলো তৈরি ও পরিবেশন করা হয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন