হারানো গলফ বল কুড়িয়ে ব্যবসা! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করেন এক মার্কিন ডুবুরি
যুক্তরাষ্ট্রের একজন মানুষ, যিনি গলফ খেলার মাঠের জলাশয়ে ডুব দেন—কারণ তাঁর পেশাটাই এমন। তিনি হলেন জিম বেস্ট। তাঁর কাজ হলো—গলফ খেলার সময় খেলোয়াড়দের পানিতে পড়ে যাওয়া বলগুলো খুঁজে বের করা। এরপর সেগুলো পরিষ্কার করে তিনি বিক্রি করেন।
বেস্ট স্বীকার করেন, তিনি ভালো গলফার নন, তবে বিশ্বের সেরা কিছু গলফ কোর্সে তাঁর নিয়মিত আনাগোনা। তিনি জানান, মাঠের সবুজ ঘাস বা ‘ফেয়ারওয়ে’-তে বল রাখতে তাঁর সমস্যা হয়। কিন্তু এই খেলার মাধ্যমেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। সবুজ ঘাসের আশেপাশে তাঁর ভালো ‘অনুভূতি’ আছে—তবে সেটা অন্যভাবে, স্কোরকার্ডের হিসাবের বাইরে। সাধারণত তিনি ১৫ আন্ডারে থাকেন, তবে এখানে স্কোর নিয়ে কথা হচ্ছে না।
জিম বেস্ট একজন ডুবুরি, যিনি খেলোয়াড়দের হারানো গলফ বল খুঁজে বের করেন এবং তা থেকে লাভজনক ব্যবসা করেন। একসময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৬৫টি কোর্সে কাজ করতেন, বছরে প্রায় ২০ লাখ বল উদ্ধার করতেন। বর্তমানে তিনি এক ডজনেরও কম কোর্সে কাজ করেন, তবে টিপিসি সাগ্রাস তাঁর প্রিয় স্থান, বিশেষ করে এখানকার ১৭ নম্বর ছিদ্র বা ‘হোল’-এর কাছাকাছি এলাকা। এই হোলের মাঝখানে একটি দ্বীপের মতো সবুজ ঘাস রয়েছে, যা খেলার আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।
সিএনএন স্পোর্টকে বেস্ট বলেন, “আমি এখান থেকে অনেক বল পাই। এখানে আসাটা আমার কাছে শস্য সংগ্রহের মতো, যেন একটি ভুট্টা খেত থেকে ফসল তোলা।” শুধু এই স্থান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার বল উদ্ধার করেন তিনি।
এই পেশাটি তাঁর কাছে আসে প্রায় আকস্মিকভাবে। ১৯৯৩ সালে সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, তিনি একটি রাস্তা ধরে সাইকেল চালাচ্ছিলেন। পথে কিছু হারানো বল দেখতে পান। তিনি তাঁর ব্যাকপ্যাক ভর্তি করে সেগুলো সংগ্রহ করেন, নিজের বেসিনে ধুয়ে ফেলেন এবং এরপর অ্যাপার্টমেন্টের কাছের গলফ শপে বিক্রি করেন।
বেস্ট বলেন, “এভাবেই আমি আমার খাবারের ব্যবস্থা করতাম! আমি ভাবলাম, ‘আরে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুরো সপ্তাহের খাবার জোগাড় হয়ে গেল!’ “
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি সেল টাওয়ারের ব্যবসা শুরু করেন, কিন্তু গলফ বল বিক্রি করাও চালিয়ে যান। যেখানে কাজ করতেন, সেখানেই তিনি বল বিক্রি করতেন। ১৯৯৮ সালে তিনি এই ব্যবসাকে আরও বড় করার সিদ্ধান্ত নেন।
ডুবুরি হিসেবে সনদ নেওয়ার পর তিনি বিভিন্ন গলফ কোর্সের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং তাঁদের হারানো বলগুলো উদ্ধারের একচেটিয়া অধিকার পান।
টিপিসি সাগ্রাসের ১৭ নম্বর হোলের সবুজ ঘাস পানির উপর থেকে দেখতে সুন্দর মনে হলেও, ভেতরের দৃশ্য তেমন নয়। বেস্ট জানান, এখানকার ঘোলা পানিতে ট্যানিন এবং শৈবাল থাকতে পারে। যখন তিনি নিচে নেমে বলের জন্য হাত বাড়ান, তখন পলিমাটির কারণে দৃশ্যমানতা আরও কমে যায়। সৌভাগ্যবশত, ঘাসের উপরে খেলোয়াড়রা যেমন তাদের ‘পুট’ পড়তে পারে, তেমনি তিনি পানির নিচে তলদেশের গঠন সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন।
বেস্ট বলেন, “কয়েকবার করার পর, আপনার মন না দেখেই সবকিছু দেখতে পায়। এখানকার গভীরতা ৬ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে, মাঝে মাঝে ২০ ফুট পর্যন্ত হয়। সেখানে ছোট ছোট টিলাও রয়েছে।”
প্রতিবার ডুব দেওয়ার সময় তিনি সাথে কয়েকটি অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নেন এবং ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা পানিতে কাটান। শুধু ১৭ নম্বর হোলের আশেপাশে তিনি একসঙ্গে ৬ হাজার পর্যন্ত বল সংগ্রহ করেছেন। বেস্ট বলেন, “তবে আপনি কখনোই সব বল খুঁজে পান না, যতই ভালো ডুবুরি হোন না কেন।”
গলফ খেলার মাঠ থেকে উদ্ধার করা বলগুলোর প্রায় ১০ শতাংশ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়। কারণ, পানির কারণে বলের ভেতরের আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গ্যাসের কারণে বলগুলো ফেটে যায়।
পুরো কোর্সের জলাশয়ে ডুব দেওয়া শেষ হলে তিনি তাঁর গুদামে ফিরে আসেন। সেখানে বলগুলো পরিষ্কার করা হয় এবং প্রস্তুতকারক, মডেল ও গুণমান অনুযায়ী আলাদা করা হয়। এরপর সেগুলো বিক্রি করা হয়। তবে যদি কোনো বিখ্যাত খেলোয়াড়ের বল পাওয়া যায়, তাহলে সেটি আলাদা করে রাখা হয়।
২০০৫ সালে, যখন টাইগার উডস তাঁর পঞ্চম মাস্টার্স খেতাব জিতেছিলেন, তখন বেস্ট টিপিসি সাগ্রাসে তাঁর একটি বল খুঁজে পান। বেস্ট বলেন, “আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। কারণ, আমি সেই বলটি হাতে পেয়েছিলাম, যা সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন ব্যবহার করেছিলেন।”
তাঁর সংগ্রহে আরও আছে—টাইগারের একটি বল, যা ডরালে পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়াও, ররি ম্যাকিলরয়, ফিল মিকelson-এর কয়েকটি বল এবং টম ব্র্যাডি ও পেটন ম্যানিংয়ের ব্যবহৃত বলও রয়েছে। তবে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার সম্ভবত ৪ নম্বর চিহ্নিত একটি টাইটেলিস্ট প্রো ভি ১x।
বেস্ট বলেন, “আমার কাছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বল আছে। এটির উপর লাল অক্ষরে ‘ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প’ লেখা আছে।”
পানিতে গলফ বলের এই সমাধি বেস্টের জন্য যেন আলাদিনের চেরাগ। হাজার হাজার বল পুনর্ব্যবহার করার পাশাপাশি, তিনি সেল ফোন, ক্যামেরা, সানগ্লাস, টুপি এবং এমনকি কিছু ‘স্কটি ক্যামেরন’ পুটারও খুঁজে পেয়েছেন।
বেস্ট অনুমান করেন, খেলার সময় খেলোয়াড়রা হয়তো সামান্য ভুলের কারণে বলগুলো পানিতে ফেলে দেন। তাঁর নিজেরও এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বলেন, “কয়েক বছর আগে, আমি যেখানে ডুব দিচ্ছিলাম, সেখানে ১১ ও ৯ ফুটের দুটি কুমির ছিল। আমি যতক্ষণ নিরাপদ মনে করেছি, ততক্ষণ কাজ করেছি। কুমিরগুলো বেশি কাছে আসার চেষ্টা করলে আমি দ্রুত উঠে এসেছি।”
তবে অন্য কোর্সে ডুব দেওয়ার সময় তিনি এতটা ভাগ্যবান ছিলেন না। একবার একটি কুমির তাঁর গোড়ালিতে কামড় দিয়েছিল। তিনি জানান, “আমি যখন ১৮ ফুট গভীরে ছিলাম, তখন কুমিরটি আমাকে ধরেছিল। তাদের দাঁত খুব ধারালো।”
আরেকবার একটি কুমির তাঁর অক্সিজেনের ট্যাঙ্কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২০০৭ সালে ফ্লোরিডার ইনিসব্রুক গলফ রিসোর্টে ১৪ ফুটের একটি কুমির দ্বীপের কোর্সে পানি থেকে উঠে আসে এবং গর্জন করতে শুরু করে। বেস্টের ডুবুরি বন্ধু প্যাসকাল তখন পানির নিচে ছিলেন, তিনি কোনো বিপদ টের পাননি। বেস্ট বলেন, “আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল—আবার পানিতে নেমে আমার বন্ধুকে উদ্ধার করা। আমি প্রায় কাজটি করতে চাইনি, কিন্তু পরে মনে হলো, হয় আমি সত্যিকারের মানুষ, না হয় নই।”
সুতরাং, সাগ্রাসের ১৭ নম্বর হোলে যখন কারও শট পানিতে পড়ে, তখন মনে রাখবেন—এটি হয়তো খেলোয়াড়ের জন্য প্রতিযোগিতার সমাপ্তি, তবে সেই বল এবং সেটি খুঁজে পাওয়া মানুষের জন্য এটি একটি নতুন যাত্রা শুরু করে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন