রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: কিয়েভের সেনাদের জীবন বাঁচাতে কৌশলগত পশ্চাদপসরণের ইঙ্গিত, শান্তি ফেরাতে প্রস্তুত ইউরোপ
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথমবারের মতো কুরস্ক সফর করেছেন। গত আগস্টে ইউক্রেনীয় বাহিনীর একটি অংশে কুরস্কে প্রবেশ করার পর এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেছেন যে, তার সেনারা কুরস্ক অঞ্চলকে ‘সম্পূর্ণভাবে মুক্ত’ করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গত পাঁচ দিনে ২৪টি জনপদ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের সেনারা তাদের সব যুদ্ধ মিশন সম্পন্ন করবে এবং খুব শীঘ্রই কুরস্ক অঞ্চল শত্রুমুক্ত হবে।’
পুতিনের এই মন্তব্যের কিছুক্ষণ পরেই ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওলেক্সান্ডার সিরস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সেনাদের জীবন বাঁচাতে তারা কৌশলগতভাবে পশ্চাদপসরণ করতে পারে। সিরস্কি অনলাইনে লিখেছেন, ‘সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও আমার প্রধান লক্ষ্য হলো ইউক্রেনীয় সেনাদের জীবন বাঁচানো। সেই লক্ষ্যে, প্রয়োজনীয় হলে, প্রতিরক্ষা বাহিনী আরও সুবিধাজনক অবস্থানে সরে আসবে।’ সিরস্কির এই বক্তব্যকে সেনা প্রত্যাহারের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ইউক্রেনীয় সেনাদের হটিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতে গিয়ে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ব্যাপক জনবল ও সরঞ্জামের ক্ষতি স্বীকার করছে।
কুরস্কে ইউক্রেনের দখলে যাওয়া বৃহত্তম জনপদ হলো সুজা। ইউক্রেনভিত্তিক ‘ডিপ স্টেট’ নামক একটি উন্মুক্ত-উৎস মানচিত্র প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কিয়েভ সুজার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে। সিরস্কি জানিয়েছেন, ‘শত্রুরা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভাঙতে এবং কুরস্ক অঞ্চল থেকে আমাদের সৈন্যদের বিতাড়িত করতে আক্রমণকারী সেনা ও বিশেষ অভিযান বাহিনী ব্যবহার করছে। তাদের লক্ষ্য হলো সুমি ও খারকিভ অঞ্চলে যুদ্ধ নিয়ে যাওয়া।’
অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তারা সেনাদের রক্ষার জন্য ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করছেন। কিয়েভে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া স্পষ্টভাবে আমাদের সৈন্যদের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে এবং আমাদের সামরিক কমান্ড যা করার দরকার, তাই করছে। আমরা আমাদের সৈন্যদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছি।’
যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে এবং এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়াকে আর্থিক দিক থেকে দুর্বল করার হুমকি দিয়েছেন। সৌদি আরবে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে হওয়া বৈঠকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি সমর্থন না করলে ট্রাম্প এমন পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কিয়েভ ও ইউরোপ এখন মস্কোর উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে মার্কিন দূতরা পুতিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন।
ক্রেমলিন এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ট্রাম্প বলেছেন, পুতিন যদি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তবে তিনি ‘এমন কিছু আর্থিক পদক্ষেপ নিতে পারেন, যা রাশিয়ার জন্য খুবই খারাপ হবে’। জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রাশিয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তিনি ওয়াশিংটনের কাছ থেকে কঠোর পদক্ষেপ আশা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা জোরালো পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করতে পারি। বিস্তারিত এখনো জানি না, তবে আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনকে শক্তিশালী করার বিষয়ে কথা বলছি।’
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারকো রুবিও বলেছেন, ওয়াশিংটন চায় মস্কো কোনো শর্ত ছাড়াই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হোক। কানাডায় জি-৭ বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার পথে তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে চাই তারা কোনো শর্ত ছাড়াই রাজি কিনা। যদি তারা রাজি হয়, তাহলে আমরা মনে করব শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আর যদি তারা রাজি না হয়, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে এবং তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার মধ্যে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকোর্নু প্যারিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা আসতে পারে এবং তা কার্যকর করতে ইউরোপকে প্রস্তুত থাকতে হবে। ইউরোপের পাঁচটি প্রধান সামরিক শক্তিধর দেশ—যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড ও ফ্রান্স—বুধবার ফ্রান্সের রাজধানীতে বৈঠকে মিলিত হয়ে ইউক্রেনে শান্তি রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে একটি ‘পুনর্নিশ্চয়তা বাহিনী’ গঠনের বিষয়ে আলোচনা করেছে। লেকোর্নু জানিয়েছেন, তারা ‘আগামীকালের মধ্যে যুদ্ধবিরতি দেখতে’ আগ্রহী এবং ১৫টি দেশ ৩০,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী গঠনে অবদান রাখতে প্রস্তুত, যারা ইউক্রেনের বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও অবকাঠামোকে সুরক্ষিত করবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান