ঘুমের সমস্যা: রাতে জেগে থাকা আর সকালে ক্লান্ত—বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
ঘুম আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুস্থ জীবন ধারণের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু ঘুমের সময় যদি গড়বড় হয়, অর্থাৎ রাতে ঘুম না এসে সকালে ক্লান্ত লাগে, তবে তা খুবই উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, সে বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব এবং রাতে জেগে থাকার সমস্যা নেহাতই আলস্যের ফল নয়। বরং, এটি হতে পারে ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি (sleep hygiene) সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, ঘুমের মধ্যে ব্যাঘাত অথবা অন্য কোনো ঘুম-সংক্রান্ত সমস্যার লক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান মেডিকেল স্কুলের নিউরোলজিস্ট এবং ঘুমের ওষুধ বিশেষজ্ঞ ড. সোনজা শুটজ বলেন, “ঘুমের গুণগত মান আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। ঘুমের অভাবে মানসিক স্বাস্থ্য, চিন্তাভাবনার ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে।”
এই সমস্যা সমাধানে সবার প্রথমে ঘুমের ধরণ নিরীক্ষণ করা দরকার। আপনি কখন ঘুমাতে যান এবং কখন ঘুম থেকে ওঠেন, তা নিয়মিতভাবে খেয়াল করুন। ঘুমের সময়সূচী এবং অভ্যাসের মধ্যে সঙ্গতি বজায় রাখা খুব জরুরি। ঘুমের সময় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ না নিয়ে ধীরে ধীরে চেষ্টা করুন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ মিনিট আগে ঘুমাতে যাওয়া শুরু করতে পারেন, যতক্ষণ না আপনার শরীর নতুন সময়সূচীর সঙ্গে মানিয়ে নেয়।
সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে যারা ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, তারা প্রায়ই ছুটির দিনে বেশি ঘুমিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করতে চান। কিন্তু এটি ভালোোর চেয়ে খারাপ করতে পারে। ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিক স্লিপ ডিসঅর্ডার সেন্টারের পরিচালক ড. মিশেল ডেরাপ বলেন, “সপ্তাহের শেষে স্বাভাবিকের চেয়ে এক ঘণ্টার বেশি ঘুমালে, তা সোমবারে ঘুম থেকে ওঠা আরও কঠিন করে তুলবে।” তাই, ছুটির দিনেও আপনার স্বাভাবিক ঘুমের সময় বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
ঘুমের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে কিছু বিষয় মনে রাখা দরকার। যেমন—রাতের খাবার বা ক্যাফিন গ্রহণ ও স্ক্রিন ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণ করা। ঘুমানোর অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা আগে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার বন্ধ করুন, ঘরের আলো কমিয়ে দিন এবং বই পড়া বা হালকা কোনো কাজ করুন যা মনকে শান্ত করবে। কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে পড়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কিছু রুটিন অনুসরণ করলে শরীর ও মস্তিষ্কে সতেজতা ফিরে আসে। মুখ ধোয়া, চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দেওয়া, দাঁত ব্রাশ করার মতো কাজগুলো সকালে ঘুম থেকে উঠেই করতে পারেন।
দিনের বেলায় শারীরিক কার্যকলাপ ঘুমের জন্য সহায়ক। যারা ডিজিটাল যুগে বসে কাজ করেন, তাদের ক্ষেত্রে শারীরিক পরিশ্রম কম হওয়ার কারণে রাতে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। তাই দিনের বেলায় কিছু ব্যায়াম করা ভালো।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। তবে ব্যক্তি বিশেষে ঘুমের চাহিদায় ভিন্নতা থাকতে পারে। ড. শুটজ বলেন, “অনেকের ক্ষেত্রে ৯ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন, কিন্তু তারা হয়তো জানেন না যে তাদের শরীর আসলে আরও বেশি ঘুমের প্রত্যাশা করে।”
ঘুমের সময় নিরীক্ষণের মাধ্যমে আপনি আপনার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ঘুমের পরিমাণ জানতে পারবেন এবং নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতে পারবেন।
এছাড়াও, দুপুরের স্বল্পকালীন ঘুম (২০-৩০ মিনিট) স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগের জন্য উপকারী হতে পারে। তবে দুপুরের বেশি সময়ের ঘুম বা সন্ধ্যার দিকে ঘুমালে রাতে ঘুম আসতে সমস্যা হতে পারে।
ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্লিপ অ্যাপনিয়া (sleep apnea) এর মতো ঘুমের সমস্যা। এছাড়া, কিছু ওষুধ বা মানসিক স্বাস্থ্যগত কারণেও ঘুমের সমস্যা হতে পারে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সকালে ক্লান্ত অনুভব করতে পারেন এবং তাদের ক্ষেত্রে ঘুম থেকে ওঠার পর ঝিমুনি কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
তবে, আমাদের শরীর যথেষ্ট স্থিতিস্থাপক। তাই ঘুমের সময়সূচীতে সামান্য পরিবর্তন আসতেই পারে। উদাহরণস্বরূপ, শিশুদের দেখাশোনা করা বা অসুস্থ আত্মীয়ের যত্ন নেওয়ার কারণে ঘুমের সময় পরিবর্তন হতে পারে। এক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
পরিশেষে, ঘুমের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং ঘুমের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ঘুমের সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তথ্য সূত্র: সিএনএন