যক্ষ্মা রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসামান্য অবদানের পর অবসর নিলেন ‘ক্যারোলিনা’, নামের এক বীর যোদ্ধা। এই ইঁদুর-যোদ্ধা কয়েক হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়ে এখন তার প্রিয় বন্ধু, গিলবার্টের সাথে অবসর জীবন কাটাচ্ছে।
আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া এবং ইথিওপিয়ায়, যক্ষ্মা রোগের বিস্তার কমাতে কাজ করা একটি অলাভজনক সংস্থা হলো ‘এপো’পো’ (APOPO)। এই সংস্থার ৪০ জন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইঁদুর রয়েছে, যাদের কাজ হলো যক্ষ্মা শনাক্তকরণে সহায়তা করা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলো ক্যারোলিনা। সে তার সাত বছরের কর্মজীবনে ৩,০০০ এর বেশি যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করেছে, যা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। এর ফলে, ধারণা করা হয়, প্রায় ৩০,০০০ মানুষের শরীরে সংক্রমণ ছড়ানো থেকে রক্ষা করা গেছে।
ক্যারোলিনা সাধারণ কোনো কর্মচারী নয়। সে হলো একটি বিশাল আকৃতির আফ্রিকান ইঁদুর। মানুষের তুলনায় অনেক দ্রুত, মাত্র ২০ মিনিটে সে ১০০টি থুতুর নমুনা পরীক্ষা করতে পারে। যেখানে একজন মানুষের একই পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করতে সময় লাগে প্রায় চার দিন। এপো’পোর প্রশিক্ষণ প্রধান সিন্ডি ফাস্ট জানিয়েছেন, একটি অলিম্পিক আকারের সুইমিং পুলের সমান জায়গায় এক ফোঁটার অর্ধেক ক্লোরিন শনাক্ত করার ক্ষমতা রাখে এই ইঁদুরগুলো।
ইঁদুরদের সাধারণত আমাদের সমাজে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় না। তবে, ক্যারোলিনা ও তার সঙ্গীরা তানজানিয়া ও ইথিওপিয়ার স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে যক্ষ্মা শনাক্তকরণের হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে সহায়তা করেছে। সেখানকার রোগীরা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে যে পরীক্ষা করান, তার নির্ভুলতা সাধারণত ২০ থেকে ৪০ শতাংশ হয়ে থাকে। দ্রুত ফলাফল প্রদানকারী উন্নত পরীক্ষাগুলো সহজলভ্য নয় এবং অনেক ব্যয়বহুল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ইঁদুর যক্ষ্মা শনাক্ত করলে, তার মাধ্যমে আরও ১০ থেকে ১৫ জন মানুষের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, একজন যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত আরও অনেক মানুষের মধ্যে এই রোগ ছড়াতে পারে। শুধু গত বছরই, এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে তানজানিয়া ও ইথিওপিয়ায় প্রায় ৪ লক্ষ নতুন যক্ষ্মা রোগী সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
এপো’পোর কর্মীরা জানান, তারা শুধু মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছেন না, বরং ইঁদুর সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তন করতেও কাজ করছেন। তাদের কাছে, এই ইঁদুরগুলোও তাদের সহকর্মী এবং সত্যিকারের বীর।
এপো’পোর এই কার্যক্রম ‘হিরো র্যাটস’ নামেও পরিচিত। ১৯৯০ এর দশকে তারা ল্যান্ডমাইন শনাক্ত করার প্রকল্প শুরু করেছিল। ইঁদুরের ঘ্রাণশক্তি এত তীব্র যে, তারা মাটির ৮ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত লুকানো টিএনটি বিস্ফোরকের গন্ধ শনাক্ত করতে পারে। উল্লেখ্য, ল্যান্ডমাইনগুলো সাধারণত ৬ ইঞ্চির বেশি গভীরে থাকে না।
যক্ষ্মা বর্তমানে বিশ্বে সংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যুর প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। যদিও বাংলাদেশেও যক্ষ্মা একটি গুরুতর সমস্যা, তবে সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর প্রকোপ ধীরে ধীরে কমে আসছে।
এপো’পোর কর্মীরা প্রতিদিন মোটরসাইকেলে করে স্থানীয় ক্লিনিকগুলো থেকে যক্ষ্মার পরীক্ষার জন্য সন্দেহজনক নমুনা সংগ্রহ করেন এবং তা ল্যাবে নিয়ে আসেন। এরপর প্রশিক্ষিত ইঁদুরগুলো নমুনাগুলো শুঁকে, কোনোটিতে যক্ষ্মার জীবাণু আছে কিনা, তা চিহ্নিত করে। যদি কোনো নমুনায় যক্ষ্মা শনাক্ত হয়, তবে এপো’পো নিশ্চিতকরণের জন্য আরও উন্নত পরীক্ষা করে।
ক্যারোলিনার মতো, তামাশা নামের আরেকটি ইঁদুরও এই কাজে বেশ পারদর্শী। সিন্ডি ফাস্ট জানান, তামাশা রোগীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকে। কাজ শেষে সে শব্দ করে যেন আরও কাজ করতে চায়।
ক্যারোলিনার অবসরের পর, এখন তার বন্ধু গিলবার্ট এবং আরও কিছু ইঁদুর একই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সবার জন্যই অবসর জীবনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে তারা খেলাধুলা এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সুযোগ পায়।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক